যেখানে ইফতারে একাকার ধনী-গরিব

চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : সারি সারি করে বসে আছেন হাজারো মুসল্লি। কেউ তসবিহ পাঠ করছেন, কেউ বা মশগুল দোয়া-দরুদ পড়তে। তাদের পাশেই গরম গরম পেঁয়াজু, চনা, বেগুনি, ছোলা, জিলাপিসহ হরেক রকমের ইফতার নিয়ে প্লেট সাজাতে ব্যস্ত কিছু খাদেম।

মিনিট দশেক পরেই এসব প্লেট একটি একটি করে সব মুসল্লির হাতে পৌঁছে দেওয়ার তোড়জোর। মুসল্লিদের কাতারে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী যেমন আছেন, তেমনি দিনমজুরের সংখ্যাও কম নয়। তবে নেই কোনো ভেদাভেদ। অন্য ইফতার মাহফিলের মতো নেই কোনো হইচই কিংবা বিশৃঙ্খলা। একই রকমের ইফতার দিয়ে আপ্যায়িত করা হচ্ছে সবাইকে।

এ দৃশ্য চট্টগ্রাম নগরের প্রায় ৩৬৬ বছরের ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের।

আসরের নামাজের পর থেকে মসজিদের দিকে ছুটে আসেন রোজাদাররা। ছাত্র থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষের পাশে ভিক্ষুক, রিকশাওয়ালা, হকারসহ নানা বয়সীরা একসাথে বসে পড়েন। স্বেচ্ছাসেবকরা শুরু করেন ইফতারি বিতরণ।

জানা গেছে, ২০০১ সাল থেকে এভাবেই ইফতারের আয়োজন শুরু হয় মসজিদটিতে। ২০০৮ সাল থেকে শুরু হয় বড় আকারে মক্কা-মদিনার আদলে গণ-ইফতার। এখন রোজার শুরুর দিকে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষ এখানে নিয়মিত ইফতার করেন। রমজানের শেষ দিকে সেই সংখ্যা চার হাজারে পৌঁছায়। এখানে ইফতারসামগ্রীর মধ্যে থাকে ছোলা, মুড়ি, খেজুর, শরবত, জিলাপি, আলুর চপ, সমুচা, অন্থন, পেঁয়াজু ইত্যাদি। সকাল থেকে এসব তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন বাবুর্চিরা।

আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদের খতিব আওলাদে রাসুল স. হজরত মাওলানা আনোয়ার হোসাইন তাহের জাবেরি আল মাদানী বলেন, ‘আমি এই মসজিদে খতিব নিযুক্ত হই ১৯৯৬ সনে। মক্কা-মদীনায় যেভাবে রোজাদারদের ইফতারের ব্যবস্থা থাকে আমি এই মসজিদে সেটা চালু করার স্বপ্ন দেখি। ১৯৯৭ সালে প্রাথমিকভাবে শুরু করে ২০০১ সালে এটি পরিপূর্ণ ইফতার মাহফিল হয়ে উঠে। পর্যায়ক্রমে এটি এখন গণ-ইফতারে রুপ লাভ করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি যেদিন এই দুনিয়ায় থাকবো না, সেদিনও যাতে এই ইফতার মাহফিল অব্যাহত থাকে চট্টগ্রামবাসীর প্রতি সেই অনুরোধ রইলো।’

খতিবের ব্যক্তিগত সহকারী মুহাম্মদ হাছান মুরাদ জানান, রোজা শুরু প্রথম কয়েক দিন মানুষ কম হলেও রোজা বাড়ার সাথে সাথে মানুষ বৃদ্ধি পায়। এখানে সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হয় ইফতারি। টাটকা ও স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারি যাতে সবাই খেতে পারেন সেই চেষ্টা করা হয়। মূলত আমাদের এই আয়োজনে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি সহায়তা করেন। তবে তারা নাম প্রকাশ করেন না। সবাই সওয়াবের উদ্দেশে ইফতার আয়োজনে শরিক হন। দানশীল ব্যক্তিরা ইফতারসামগ্রী দিয়ে যান। আমরা মসজিদের পেছনে ১২ জন বাবুর্চি দিয়ে সেসব রান্না করে পরিবেশন করি।

আন্দরকিল্লা প্রেস মালিক সমিতির সদস্য নাসির উদ্দিন বলেন, আন্দরকিল্লা মসজিদে প্রতিদিন শত শত মানুষের ইফতারির আয়োজন হয়। এটা এই মসজিদের ঐতিহ্য। খতিব সাহেব এটা চালু করেছিলেন। গ্রাম-গঞ্জ থেকে অনেক মানুষ শহরে কাজকর্ম সারতে আসেন, তারাও এখানে ইফতার করেন।

অক্সিজেন এলাকা থেকে ইফতার করতে আসা মুহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘এভাবে এত মানুষের সাথে ইফতার সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বাড়ায় । মানুষে মানুষে ভালোবাসা বাড়ায়। এখানে ধনী-গরিব সব মানুষ একই সারিতে বসে ইফতার সারেন। এই দৃশ্য অনিন্দ্য সুন্দর।’

প্রসঙ্গত, আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ চট্টগ্রামসহ তার আশপাশের মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার মসজিদে রূপ নেয়। বিশেষ করে জুমআর নামাজ পড়তে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে মুসল্লিরা উপস্থিত হন। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোগল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর মসজিদটির অবস্থান। চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারকস্বরূপ কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি। এটির প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি।

চাটগাঁ নিউজ/এসএ

Scroll to Top