নিজস্ব প্রতিবেদক : উত্তর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিনের বিরোধ ভুলে অবশেষে এক ছাদের নীচে মিলিত হলেন বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, সাত বারের সংসদ সদস্য, দুইবারের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও কেন্দ্রিয় যুবলীগের সদস্য বিশিষ্ট আইটি ব্যবসায়ী নিয়াজ মোহাম্মদ এলিট।
একসঙ্গে দুজনের বৈঠকের হাস্যোজ্জ্বল ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে। অনেকে এটিকে মিরসরাইয়ের রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। বছরের পর বছর দুই নেতার বিরোধের কারণে মিরসরাই আওয়ামী রাজনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে।
দুই নবীন-প্রবীণ নেতাদের সমঝোতা মাধ্যমে মিরসরাইয়ে সহিংসতার রাজনীতির অবসান ঘটবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক মহল।
সাহেরখালী ইউনিয়নের তৃণমূল নেতা আশফাক তানভীর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, দুই নেতা একসঙ্গে ছবি দেখে ভালো লাগছে। এবার মিরসরাইয়ে শান্তি ফিরবে আশা করছি। আর কোন নেতাকর্মীর রক্ত ঝরবে না।
৫২ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের। তিনি বিগত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নেননি। এমন খবর যখন উপজেলা জুড়ে প্রচার হয় তখনই শুরু হয় আলোচনা। কিন্তু তিনি মনোনয়ন না নিলেও মনোনয়ন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন তাঁর পুত্র চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মাহবুবুর রহমান রুহেল।
আওয়ামী লীগ থেকে আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন বড়তাকিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, যুবলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিট। তিনি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ক্রিকেট কাউন্সিলের পরিচালক, বাংলাদেশ জুনিয়র ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনিও এলাকায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মূলত নিজের রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে গিয়ে বার বার বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।
২০১৯ সালে শেখ ফজলে শামস পরশ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তার হাত ধরে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য নির্বাচিত হন নিয়াজ মোর্শেদ এলিট। তারও আগে তিনি আওয়ামলীগের আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এলাকায় নিয়মিত যাতায়াতের ফলে মিরসরাই উপজেলা আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দীর্ঘ দিনের কোনঠাসা ও বঞ্চিত নেতাকর্মীরা এলিটের পেছনে জমায়েত হতে শুরু করেন। নেতাকর্মীদের নিয়মিত যাতায়াত হয়ে ওঠে মিরসরাই উপজেলার ১২নং খৈয়াছড়াস্থ তার নিজ বাড়িতে।
এই পরিস্থিতি মোটেই সহ্য হচ্ছিল না পাঁচ দশক ধরে মিরসরাইয়ের আওয়ামী রাজনীতির একমাত্র নীতিনির্ধারক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তিনি তার অনুসারীদের দিয়ে এলিটকে মিরসরাই ছাড়া করার চেষ্টা করেন। এমন কি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সমর্থকরা এলিটের বাড়িতে একাধিকবার অতর্কিত হামলা চালায়। বাড়ি লক্ষ করে ককলেট বিস্ফোরণ ও গুলি করা হয়। এসবের পরেও দমে যাননি এলিট।
হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলে, হামলার নেতৃত্ব দাতা মিরসরাই উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি আশরাফুল কামাল মিঠুকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। আশরাফুল কামালকে উদ্ধার করতে নাকানি চুবানী খেতে হয় ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসনকে। এরপর মোশাররফপন্থীরা একটু দমে গেলেও মাস কয়েক যেতেই আবার হামলার ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় এক প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতার কবর জিয়ারত করতে গেলে ১১নং মঘাদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে এলিটের গাড়ি বহরে হামলা চালায় ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সমর্থকরা। হামলার ঘটনায় গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। এতে নিয়াজ মোর্শেদ এলিটের অনুসারী ৫ জন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী রক্তাক্ত আহত হন। এ ঘটনায় উভয় পক্ষ আদালতে পাল্টাপাল্টি মামলা দায়ের করেন। সে মামলায় গ্রেপ্তার হন সম্প্রতি মোশাররফ হোসেন সমর্থিত চেয়ারম্যান।একারণে রাজনৈতিক চাপে পড়েন মোশাররফ।মূলত চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারের পর থেকে এলিটের সাথে আপোষের চেষ্টা করেন মোশাররফ।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে একাধিবার এলিটকে ফোন করে বৈঠকে বসা এবং দুই চেয়ারম্যানকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনুরোধ করেন মোশাররফ। কিন্তু এতে সাড়া দেয়নি এলিট। শেষ পর্যন্ত এলিটের পিতা বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলাম ইউসুফের দারস্থ হন তিনি। মূলতঃ পিতাকে দিয়েই ছেলেকে মোশাররফ হোসেনের বাসায় বৈঠকে ডাকেন। তবে ঘন্টাব্যাপী এলিট-মোশাররফের বৈঠকে কি কি বিষয়ে কথা হয়েছে জানা না গেলেও ফেসবুকে তাদের দুজনের হাস্যজ্জোল ছবি দেখে নেতাকর্মীরা মিরসরাই রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন চাটঁগা নিউজকে বলেন, ও (এলিট) যেহেতু আমার বাসায় আসছে। একজন ভদ্রলোক হিসেবে রিসিভ করতে হয়। বুঝাপড়া আসলে তার বাবার সাথে হয়েছে। সেই পাঠিয়েছে। রাজনৈতিক দলাদলি কিছু না। সে যুবলীগ করে। আমরা সবাই একই দল করি, কেউ আওয়ামীলীগ, কেউ যুবলীগ, কেউ ছাত্রলীগ করি। আমাদের মধ্যে কোন ধরণের ডিফারেন্স থাকা উচিত না।
আপনার সমর্থিত দুই চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারের পর নাকি আপনি উনাকে ডাকছেন এমন প্রশ্ন করলে, সরাসরি অস্বিকার করেন প্রবীণ এই নেতা। মিরসরাইবাসী কোন গোলমালের মধ্যে নাই। সবাই এক আছে।
এ ব্যাপারে নিয়াজ মোর্শেদ এলিট বলেন, ওনি (মোশাররফ) আজ ফাইনালি আপোষ মিমাংসায় বসেছে। যেহেতু আমি মিরসরাইর সন্তান বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করি, রাজনীতি করতে গেলে অনেক সময় মতের অমিল বা দ্বিমতের থাকতে পারে। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন যেহেতু আওয়ামী লীগে প্রেসিডিয়াম সদস্য, উনি আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক, উনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সে হিসেবে উনার সাথে আমি সৌজন্য সাক্ষাত করেছি। আগামী দিনের মিরসাইয়ের রাজনীতি কিভাবে হবে সে বিষয়ে কথা হয়েছে। এলাকায় যেহেতু পলিটিক্স নিয়ে ঝামেলা হচ্ছিল এসব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। আমি একজন আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে যাওয়াটা উচিত মনে করেছি।
এক প্রশ্নে জবাবে এলিট বলেন, কিছু সমস্যা ছিল। নেতাকর্মীদের বাড়ীতে হামলা হয়েছে। আমার বাড়ীতে হামলা হয়েছে।আমাকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করেছে। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। আইন তার মত করে কাজ করেছে একজন লোকাল চেয়ারম্যানসহ কয়েকজনকে অ্যারেস্ট করেছে। সব কিছু মিলিয়ে যেহেতু আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করি। তািই মোশাররফ ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে মিউচুয়াল সমাধান করে নিয়েছি।
অপর এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, কোন শর্ত ছিল না। ইনি আমাদের মুরুব্বি, উনি একটা সমাধান চেয়েছেন। এখানে কোন দেয়া নেয়ার কিছু ছিল না।
তিনি বলেন, গত এক সপ্তাহ ওনার এক চেয়ারম্যানকে তুলে নিয়ে গেছিতো (পুলিশী গ্রেপ্তার)। তাকে তিনি জেল থেকে বের করতে পারছেন না।
চাটগাঁ নিউজ/এও/এসআইএস