ফরহাদ সিকদার : দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ ভারত। আয়তনে এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে বৃহৎ এই দেশটি গত এক দশক ধরে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর অতিরিক্ত মোড়লগিরির কারণে এখন অনেকটাই একঘরে। যেনো পাড়ার সেই চিহ্নিত নিকৃষ্ট ব্যক্তিটির মতো, যার টাকা পয়সা থাকলেও তাকে গোনাই ধরছে না কেউই।
ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী তার উত্তর দিকে অবস্থান করছে চীন, নেপাল ও ভুটান। আর পূর্ব দিকে অবস্থান করছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। পশ্চিম দিকে পাকিস্তান ও কিছু অংশ জুড়ে আফগানিস্তান। সর্বশেষ দক্ষিণ দিকে রয়েছে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ। কিন্তু গত এক দশকে কি এমন ঘটলো যে কারণে এই ৯ দেশের একটির সাথেও সম্পর্ক ভালো নেই ভারতের।
ঠিক এক দশক আগে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছিলেন, তখন প্রতিবেশী সবগুলো দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের দিল্লিতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিরাট একটা চমক দিয়েছিলেন তিনি। এমন কী ‘দাওয়াত’ পেয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও। মোদী সরকার সেই প্রথম দিন থেকেই বরাবর বলে এসেছে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে প্রতিবেশীরা। কিন্তু মুখের কথা এক জিনিস আর সেটা কাজে পরিণত করা ভিন্ন জিনিস। গত এক দশকে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করায় প্রবল ভারত বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠেছে সে দেশের জনগণের মধ্যেও। আর স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়েছে প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায়। শুরুতেই আসা যাক ভারতের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত মালদ্বীপ ও শ্রীলংকাকে নিয়ে।
মালদ্বীপে গত বছর ভারতপন্থী একটি সরকারকে হঠিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন মোহামেদ মুইজ্জু, যার নির্বাচনী স্লোগানই ছিল ‘ইন্ডিয়া আউট’। শুধু তাই নয়, মালদ্বীপে ক্ষমতায় আসার পর প্রত্যেক প্রেসিডেন্টেরই প্রথম বিদেশ সফরটা হয় ভারতে। আর সেই প্রথা ভেঙেছেন প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু। তিনি প্রথম সফরের জন্য বেচে নেন তুরস্ককে। পাশাপাশি এ বছরের শুরুর দিকে চীন সফর থেকে ফিরে এসেই ভারতকে অনুরোধ করেন যেনো মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ভারত সেই অনুরোধ মেনে নিয়ে সেনাও প্রত্যাহার করে নেয়। এমনকি ভারতকে পিঠ দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু এখন চীনের দিকে ঝুঁকছেন কোনও রাখঢাক না-রেখেই।
অন্যদিকে, শ্রীলংকায় বর্তমানে শাসনব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন বামপন্থী নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকে। মতাদর্শের দিক থেকে ক্ষমতাসীন ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির সাথে আকাশ পাতাল পার্থক্য তার। আর সাধারণত বামপন্থী সরকারকে মতাদর্শগতভাবে চীনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে মনে করা হয়। এই পরিস্থিতিতে দিসানায়েকে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ভারতের জন্য অবশ্যই চ্যালেঞ্জের বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কেননা, নির্বাচনের আগে দিসানায়েকে যেভাবে ভারতীয় ব্যবসায়ী আদানি গোষ্ঠী পরিচালিত বায়ু শক্তি প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ স্মরণে রেখে তার দলকে ‘ভারত বিরোধী’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে একটা রাজনৈতিক বিতর্কের সময়, দিসানায়েকে আদানি গোষ্ঠীর বায়ু শক্তি প্রকল্পকে বাতিল করার অঙ্গীকার করেছিলেন। এই প্রকল্প ‘শ্রীলঙ্কার সার্বভৌমত্বের ক্ষয়’ বলেও সেই সময়ে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
এবার দেখে নেয়া যাক নেপাল ও ভুটানের সাথে ভারতের সম্পর্ক কেমন?
ধর্মীয় দিক দিয়ে নেপালের সাথে ভারতের মিল থাকলেও পানি বণ্টন, মানচিত্র বিরোধ, অসম বাণিজ্য ও আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোদি সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে নেপালের সাধারণ মানুষের মনে এখন ভারত বিরোধীতা অনেকটাই প্রকট। নেপালে নতুন সংবিধান প্রণয়নের সময় ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে যে ‘অর্থনৈতিক অবরোধ’ কর্মসূচি পালিত হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে সে দেশের সাধারণ মানুষ ভারত-বিরোধী প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। নেপালের ক্ষমতাতেও আছেন কে পি শর্মা ওলি, যিনি কট্টর ভারত-বিরোধী বলেই পরিচিত।
অন্যদিকে, ভুটানের সাথেও দিন দিন সম্পর্কের অবনতি ঘটছে ভারতের । একসময় বিনামূল্যে ভুটানে ঘুরতে যেতে পারতো ভারতীয়রা। সেই জায়াগায় ভুটানে ভ্রমণ করতে ভারতীয়দের এখন মাথাপিছু ১২০০ রুপি করে প্রতিদিন “Sustainable Development Fee” (SDF) প্রদান করতে হয়। এমন কী, যে ভুটান সামরিক, বৈদেশিক বা অর্থনৈতিক– প্রায় সব ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরশীল, তারাও চীনের সঙ্গে আলাদাভাবে সীমান্ত আলোচনা শুরু করেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে চীনের প্রস্তাবকেও সরাসরি নাকচ করে দেয়নি ভুটান। তাই বলা চলে, দিন দিন ভারতের আধিপত্য থেকে সরে আসতে চাচ্ছে ভুটানও।
অন্যদিকে, আফগানিস্তান ও মিয়ানমারে যে দুটো সরকার এখন ক্ষমতায়, তাদের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক ভাল এ কথা বলা চলে না কোনও মতেই। তালেবানের সঙ্গে ভারতের এখনও পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কই স্থাপিত হয়নি। ভারত তালেবান-পূর্ব আফগানিস্তানের প্রজাতন্ত্রী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। এমনকি পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে, সেসময় আদানি কিংবা আম্বানিদের মাধ্যমে আফগানিস্তানে বেশকিছু বিনিয়োগও করে ভারত সরকার। সেসব বিনিয়োগ এখন বলতে গেলে হুমকির মুখে।
ঐতিহাসিকভাবে ভারত আর তালেবান একে অপরের শত্রু। ফলে নতুন তালেবান সরকারের সাথে ভারতের কিছু ব্যবসায়ীক চুক্তি হলেও, ভারত ও তালেবান দুই পক্ষ পরস্পর সম্পর্কিত হতে চাইছে—সেটা ভাবা এক কথায় বিস্ময়কর।
এদিকে, পশ্চিম মিয়ানমারে আরাকান বিদ্রোহীরা ক্ষমতা দখলের পথে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম দি প্রিন্টের একটি বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, আরাকান আর্মি এখন রাখাইন প্রদেশের আট-দশমাংশ নিয়ন্ত্রণ করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই অঞ্চলটি জান্তার নিয়ন্ত্রণ থেকে প্রথম মুক্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উত্তর পূর্ব ভারতে বিদ্রোহীদের ওপর আরাকান আর্মির উত্থান স্বাভাবিকভাবেই ভারত সীমান্তে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এবং যেহেতু আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের উপর চীনের একটা বিশাল প্রভাব রয়েছে। তাই মিয়ানমারে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেনা ভারত সরকার। এমনকি মিয়ানমারে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে হুমকির মুখে পড়েছে সে দেশে থাকা ভারতের সকল বিনিয়োগ।
তবে চীন আর পাকিস্তানের কথা আমাদের আজকের আলোচনায় না আনলেও চলে। কেননা চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে এমনটা ভাবা আর সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হওয়া একই কথা।
আর এই তালিকায় সবশেষ সংযোজন বাংলাদেশ। যেখানে বিগত দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর চরম আধিপত্যবাদ কায়েম করেছে ভারত। অসম বাণিজ্য, পানিবন্ঠন নিয়ে দীর্ঘদিনের অসম চুক্তি, সামরিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ নানানভাবে ভারত মোড়লগিরি করেছে বাংলাদেশের উপর। আর তাই তো গত এক দশকে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যতটা না আওয়ামী বিরোধী মনোভাবের জন্ম নিয়েছে তার চাইতে বেশি জন্ম নিয়েছে ভারত বিরোধীতা। যার ফলে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার পরাজয়কে ভারতের কূটনৈতিক পরাজয় হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন অনেকেই।
আর শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে চাইছে ভারত এমনটাও বলছেন অনেকেই। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদকে তারা বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে নানানভাবে। সর্বশেষ হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণসহ চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবী হত্যা এসব কিছু উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রভাব বলেই মনে করছেন সচেতনমহল। এমনকি এই ঘটনায় ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতাকর্মীদের হামলায় ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, ভাঙচুর ও বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। যদিও বর্তমানে ভারতের সাথে বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি, প্রতিক্রিয়া, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এসবকিছু চলতে থাকলেও বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত শেখ হাসিনাকে ভারত নিজেদের আশ্রয়ে রেখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কিভাবে সম্পর্কের উন্নয়ন করবে সেটিই এখন ভাবার বিষয়?
চাটগাঁ নিউজ/এসএ