বিএসসি’র জাহাজে একের পর এক দুর্ঘটনার রহস্য কি!

নিজস্ব প্রতিবেদক : এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) দুটি লাইটার জাহাজ বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি’তে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বাংলার জ্যোতির দুর্ঘটনাটি গ্যাস বিষ্ফোরণ থেকে ঘটেছে তদন্তে এমনটি উঠে আসলেও বাংলার সৌরভের অগ্নিকাণ্ড নাশকতা বলে সন্দেহ করছে বিএসসি।

যেন হারাধনের দশটি ছেলে হারিয়ে যাওয়ার মতো একের পর এক দুর্ঘটনায় ধ্বংস হচ্ছে বিএসসি’র একেকটি লাইটার জাহাজ। এমন অবস্থায় নৌ পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা বিএসসি’র ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এমন শুধু নয় , পরিকল্পিত উদাসীনতায় বিএসসি’কে জাহাজ শূণ্য করে দেশের নৌ পরিবহন বাণিজ্য অন্যের হাতে হস্তান্তরের সুক্ষ্ণ প্রক্রিয়া চলছে- এমন প্রশ্নই এখন দানা বেঁধে ওঠেছে।

‘বাংলার সৌরভ’ জাহাজে অগ্নিকান্ডের ঘটনাটিকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে মানতে নারাজ বিএসসি। শুক্রবার রাত পৌনে ১টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের পর শনিবার সকালের সংবাদ সম্মেলনে বিএসসি’র এমডি কমডোর মাহমুদুল মালেক এই অগ্নিকান্ডকে ‘নাশকতা’ সন্দেহ করছেন। তিনি বলছেন, ‘বাংলার সৌরভ’ জাহাজে যখন আগুন লাগে ঠিক একইসময়ে পাশ দিয়ে একটি স্পীডবোটও যায়। জাহাজের সম্মুখ অংশ থেকে একই সঙ্গে চার জায়গায় আগুন লাগে। অথচ জাহাজে কোনো বিস্ফোরণ হয়নি। যেহেতু গ্যাস ফর্ম কিংবা অন্য কোনো কারণে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেনি। তাই আমরা ধারণা করছি, এটি নাশকতামূলক অগ্নিকাণ্ড হতে পারে। কিন্তু সবকিছু তদন্তের পরেই জানা যাবে।

এদিকে বাংলার সৌরভ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসসি। আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কমিটিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বিএসসি’র সূত্রে জানা যায়, বাংলার সৌরভ’র এটি দ্বিতীয় বার অগ্নি দুর্ঘটনা। ২০০৭ সালের জুন মাসে এটিতে বিষ্ফোরণ ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় একজন ডেক ক্যাডেটের মৃত্যু হয়েছিল। কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স দেড় বছর ধরে মেরামতের পর আবার জ্বালানি পরিবহন কার্যক্রম শুরু করে বাংলার সৌরভ। জাহাজটিকে ১৯৮৬ সালে তৈরি করেছিল ডেনমার্ক। বিএসসির বহরে জাহাজটি যুক্ত হয় ১৯৮৭ সালের ১৫ মে।

এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে ‘বাংলার জ্যোতি’তে গ্যাস বিষ্ফোরিত হয়ে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে বাংলার জ্যোতির ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা, চার্জম্যান নুরুল ইসলাম ও বিএসসি মেরিন ওয়ার্কশপের কর্মচারী মো. হারুণ নিহত হন। বর্তমানে অকার্যকর লাইটারটিকে ড্রাইডকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সপ্তাহের ব্যবধানে বিএসসি’র বহর থেকে দুটো জাহাজ বাদ হয়ে পড়েছে। বিকল হতে হতে বিএসসির হাতে থাকা ৪৪টি জাহাজের মধ্যে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির হাতে আছে আর মাত্র পাঁচটি জাহাজ। সেগুলোও প্রায় মেয়াদোত্তীর্ণ বলে জানা গেছে। বলতে গেলে এক প্রকার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বিএসসি।

চট্টগ্রাম শিপিং করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, ৪৪টি জাহাজের মধ্যে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের অধীনে প্রথম জাহাজটি কেনা হয় ১৯৫৪ সালে ‘এমভি সিলেট’। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির বহরে ছিল ১৪টি জাহাজ। নতুন জাহাজ যুক্ত হওয়ায় ১৯৮২ সালে বহরে ছিল ২৭টি। ২০০৮ সালে সে সংখ্যা আবার ১৩টিতে নেমে আসে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তিনটি করে প্রতিষ্ঠানে আবার ছয়টি জাহাজ কেনা হয়। ছয়টির মধ্যে তিনটি ‘অয়েল কেমিক্যাল ট্যাংকার’ ও বাকি তিনটি ‘বাল্ক ক্যারিয়ার’।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলমান সময় গত ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অলভিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করছিল বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটি। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে। হামলার সপ্তম দিনে বাংলাদেশি জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধি’তে মিসাইল হামলা হয়। এতে নাবিক হাদিসুর নিহত হন। হামলার পর থেকে সেটি ইউক্রেনের বন্দরেই পড়েছিল। তবে এর জন্য ২০২৩ সালে বিমা কোম্পানির কাছ থেকে দুই কোটি ২৪ লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল বিএসসি। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পেলেও ধ্বংসকৃত বাংলার সমৃদ্ধির স্থলে আর নতুন কোন জাহাজ ক্রয় করেনি বিএসসি। ২০১৮ সালে সেটি বিএসসি’তে যুক্ত হয়েছিল।

অকেজো হতে হতে সর্বশেষ বিএসসি’র বহরে সাতটি জাহাজ ছিল। এগুলো হল – এমটি বাংলার জ্যোতি, এমটি বাংলার সৌরভ, এমভি বাংলার জয়যাত্রা, এমভি বাংলার অর্জন, এমটি বাংলার অগ্রগতি, এমটি বাংলার অগ্রযাত্রা ও এমটি বাংলার অগ্রদূত। এখন সপ্তাহের মধ্যে অগ্নিকান্ডে নষ্ট হল বাংলার জ্যোতি আর বাংলার সৌরভ। বর্তমান শুধু মাত্র পাঁচটি জাহাজ রয়েছে।

তবে কেন বিএসসি’র জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়ছে ? বা নতুন কোন জাহাজ ক্রয়ের পরিকল্পনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের সচিব আবু সাফায়াৎ মুহম্মদ শাহেদুল ইসলাম।

তিনি বলছেন, বিএসসির বহরে এখন জাহাজ আছে আর মাত্র পাঁচটি। বিষ্ফোরণে কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিবেদন দাখিলের পর ঘটনার প্রকৃত কারণ হয়ত জানা যাবে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলা আমার পক্ষে এখন সম্ভব নয়।

তবে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসসি’তে দিনের পর দিন যেভাবে জাহাজ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেড়ে চলেছে জাহাজের সংখ্যা। এর পেছনে অদক্ষতা ও অপরিকল্পিত কার্যক্রমকে কারণ হিসেবে দেখছে নৌপরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, একসময় একটি মাত্র জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল কেএসআরএম, মেঘনা এবং আকিজ গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠানের বহরে এখন ২০-২৫টি করে জাহাজ আছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বর্তমানে ১০০টি বড় জাহাজ আছে। বর্তমানে বৈশ্বিক নৌ-বাণিজ্যের যুুগ। সারা বিশ্ব নৌ বাণিজ্যের গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু ভৌগলিক অবস্থানগত উপযোগিতা থাকা সত্ত্বেও নৌ বাণিজ্য নিয়ে বাংলাদেশে তেমন উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। অথচ এই সেক্টরে বাংলাদেশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল এখনও আছে।

চাটগাঁ নিউজ/উজ্জ্বল/জেএইচ

Scroll to Top