নিজস্ব প্রতিবেদক : দিন দিন কমে যাচ্ছে ওয়াসার আয়। তারওপর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ঋণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ, পানির উৎপাদন খরচ মেটানোসহ আনুষঙ্গিক খরচ সামাল দিতে সংস্থাটির এখন লেজে গোবরে অবস্থা। এসব সংকট থেকে উত্তরণে সংস্থাটি এখন পানির দাম বাড়ানো, সিস্টেম লস কমানো ও ডিজিটাল স্মার্ট মিটার বসানোসহ নানামুখী ব্যয় সংকোচনের উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছেন, আয় বাড়াতে হলে ওয়াসাকে প্রথমে আয় কমে যাওয়ার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধান করে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
চাটগাঁ নিউজের অনুসন্ধানে ওয়াসার আয় কমে যাওয়ার কিছু কারণ উদঘাটন হয়েছে। তা তুলে ধরা হলো-
চট্টগ্রাম ওয়াসার রাজস্ব শাখার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৩ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার টাকা, ফেব্রুয়ারি মাসে ২২ কোটি ৭৫ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, মার্চ মাসে ২২ কোটি ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা, এপ্রিলে ২২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, মে মাসে ২২ কোটি ৭৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা, জুনে আদায় হয় ২৩ কোটি ২০ লাখ টাকা (ক্লোজিং ইয়ার)। তবে জুলাই মাসে আদায় হয়েছে ১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আগস্টে আদায় হয়েছে ১৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং সেপ্টেম্বরে আদায় হয়েছে ১৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রাম ওয়াসার আয় এভাবেই কমছে।
আয় কমার কারণ—
পুরানো লাইন : চট্টগ্রাম ওয়াসায় ৪০০ কিলোমিটারের পুরাতন পানির পাইপলাইন দিয়েই নগরীর বিভিন্ন এলাকা পানি সরবরাহ করা হয়। এই ৪০০ কিলোমিটার পুরাতন পানির লাইনভুক্ত এলাকাগুলো হচ্ছে- কাট্টলী, জাকির হোসেন সড়ক, দক্ষিণ খুলশী, ফয়’স লেক, আকবরশাহ ও হাটহাজারীর ওয়াসা অধিভুক্ত এলাকা। পুরানো হয়ে যাওয়ায় পাইপ লাইনগুলোতে পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। গ্রাহকের নিয়মিত পানি না পাওয়া, গড় বিল হয়রানি, পানির অপচয়সহ পানি নিয়ে সমস্যা লেগেই থাকে। তবে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প–২ এর অধীনে শহরের কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন এলাকায় ৭০০ কিলোমিটার পাইপলাইন প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
গ্রাহক ক্ষোভ : পুরানো পাইপলাইন এলাকা নগরীর পতেঙ্গা, কাট্টলী, জাকির হোসেন সড়ক, দক্ষিণ খুলশী, ফয়’স লেক, আকবরশাহ ও হাটহাজারীর বিভিন্ন এলাকায় ১৫ দিনে একবারও পানি পাওয়া যায় না। আবার পানি এলেও তা ঘন্টাখানেকও থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে। নিয়মিত পানি বঞ্চিত থাকায় ক্ষুব্ধ গ্রাহকেরা ওয়াসার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতেও বাধ্য হয়েছেন অনেকবার। এমন অবস্থায় বঞ্চিত গ্রাহকেরা ওয়াসার পানির বিলও পরিশোধ করছে না।
সিস্টেম লস : সিস্টেম লস মানে ওয়াসার ইনকাম লস। চট্টগ্রাম ওয়াসার মোট সরবরাহ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৯ কোটি লিটার পানি অপচয় হচ্ছে। যা সরবরাহকৃত মোট পানির প্রায় ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ। ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি হাজার লিটার পানির উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে ৩১ দশমিক ৮০ টাকা। সেই হিসাবে ৯ কোটি লিটার পানি সিস্টেম লসের কারণে ওয়াসার দৈনিক লস হচ্ছে ২৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা।
চোরাই পানির ব্যবসা : দৈনিক ৯ কোটি লিটার পানিকে ওয়াসা সিস্টেম লস হিসেবে দেখিয়ে দায় সারছে। অথচ অভিযোগ রয়েছে, সিস্টেম লসের সিংহভাগ পানি সংস্থাটির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্রি করে দিচ্ছেন। ওয়াসার পানি বিক্রির পেছনে ওয়াসার উর্ধ্বতন থেকে শুরু করে সিবিএ নেতাকর্মীরা পর্যন্ত জড়িত। এই পানি বিক্রি করে গাড়ি, বাড়ি, কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন অনেকেই।
জনবল সংকট : বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসায় মোট পানির সংযোগ আছে ৮৮ হাজার ৭৭১টি। এর মধ্যে ৮২ হাজার ৬৪২টি আবাসিক এবং ৬ হাজার ১২৯টি অনাবাসিক সংযোগ। অথচ এই বিশাল গ্রাহক সংখ্যার বিপরীতে ওয়াসার মিটার রিডার রয়েছেন মাত্র ৪২ জন। অর্থ্যাৎ একজন মিটার রিডারের ভাগে পরিদর্শনের দায়িত্ব পড়ে প্রায় ২ হাজার ১১৩টি মিটারের। বাস্তবে যা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার।
তবে ওয়াসা বলছে, এখনো বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার দেখে বিল করেন মিটার রিডাররা। প্রশ্ন রয়েছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার দেখে বিল তৈরির অসম্ভব কাজটি কিভাবে করেন তারা? তাছাড়া গড় বিল তৈরি করা, রিডিং কম দেখানো, টাকার বিনিময়ে অবৈধ সংযোগ দেয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে।
এদিকে, আয় কমে যাওয়াতে নানামুখী চাপে পড়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। বিগত সরকারের আমলে গৃহিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ওয়াসাকে জাইকাসহ কয়েকটি দাতা সংস্থার দ্বারস্থ হতে হয়েছে। সুদাসলসহ এই ঋণের মোট পরিমাণ ৩ হাজার ৫৫৮ কোটি ৩৯ লাখ ৭৯ হাজার ২০৩ টাকা। আগামী অর্থবছর থেকে এই ঋণের টাকার পরিশোধও শুরু করতে হবে ওয়াসাকে। এ অবস্থায় আয়মুখী কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এর মধ্যে পানির দাম বাড়ানো, ডিজিটাল স্মার্ট মিটার বসানো উল্লেখযোগ্য।
ওয়াসা সূত্র জানায়, এক ইউনিট (এক হাজার লিটার) পানির উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ৩১ দশমিক ৮০ টাকা। অথচ আবাসিকে পানির দাম প্রতি ইউনিট ১৮ টাকা বাণিজ্যিকে ৩৭ টাকা। এতে দেখা যাচ্ছে প্রতি হাজার লিটার পানিতে ১২ দশমিক ৯ টাকা করে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। এজন্য পানির নতুন মূল্য নির্ধারণ করে একটি প্রস্তাবনা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে ওয়াসা। নতুন প্রস্তাবনা অনুযায়ী, আবাসিক সংযোগে প্রতি ইউনিট পানির দাম ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৯ টাকা এবং বাণিজ্যিক সংযোগে ৩৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৯ টাকা ৭০ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. মাকসুদ আলম বলেন, সিস্টেম লস কমাতে বিল পরিশোধ প্রক্রিয়াকে অটোমেশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পিওর আলট্রাসনিক ডিজিটাল মিটার বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। এই মিটারের মাধ্যমে সরাসরি অনলাইনে অটোমেটিক বিল রিড হবে সেন্ট্রালি। চান্দগাঁও ও আগ্রাবাদ এলাকায় ৩ হাজার স্মার্ট মিটার বসানোর পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। পাইলট প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
তিনি আরও বলেন, পুরোনো পাইপলাইনের স্থলে নতুন পাইপলাইন বসানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকার এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। নতুন পাইপলাইন এবং স্মার্ট মিটার প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সিস্টেম লস অনেকটা কমে যাবে বলে আশা করছি।
চাটগাঁ নিউজ/উজ্জ্বল/এসএ