বরেণ্য আইনবিদ মরহুম আলহাজ্ব আহমদ ছগির স্মরণে

জিয়া হাবীব আহসান, এডভোকেট :

মরহুম এডভোকেট আহমদ ছগীর ছিলেন মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রয়াসী এক রাজনীতিবিদ ও আইনবিদ । আগামী ২৩ জুন ২৪, তাঁর ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী, তিনি ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা বার এসোসিয়েশন এর সাবেক সম্পাদক ও সভাপতি, চট্টগ্রাম আইন কলেজের সাবেক শিক্ষক, বুজুর্গ আইনবিদ, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবীদ তিনি বাম রাজনীতি ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। তিনি খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ প্রভৃতি ইসলাম সংগঠনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন । করোনা কালীন দূ:সময়ে গত ২৩ জুন ২০২০ ইং মংগলবার সকালে তিনি তাঁর দ্বিতীয় সন্তান প্রকৌশলী আহমদ মাইনুদ্দিনের মেহেদী বাগস্থ সরকারী বাস ভবনে ইন্তেকাল করেন।ঐদিন বাদ জোহর মেহেদী বাগ সিডিএ জামে মসজিদ সংলগ্ন কলোনি মাঠে মরহুমের ১ম নামাজে জানাজায় এমন দূ:সময়েও বহু মানুষ হাজির হন। আমি নিজেও এ প্রিয় মানুষটিকে একনজর দেখতে সেখানে ছুটে যাই ও জানাজায় অংশ গ্রহন করি। পরে পটিয়া নাইখাইনস্থ তাঁর নিজ গ্রামে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।শ্রদ্ধেয় ছগির চাচার সাথে ২০০১ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করেছিলাম।বহু স্মৃতি আজো চোখে ভাসছে।চট্টগ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের শালিশে সমস্ত পে অর্ডার গুলো বার এসোসিয়েশন সভাপতি হিসেবে তাঁর কাছে আমানত হিসেবে জমা রাখি। সমস্যার সমাধান না হওয়ায় চার পাঁচ বছর পর্যন্ত তা তাঁর কাছে জমা ছিল। হঠাৎ তিনি আমার চেম্বারে এসে বলেন, বাবাজি হায়াৎ মওতের বিশ্বাস নেই, আমি এগুলো আর জমা রাখতে পারবো না।যার যার হক বুঝিয়ে দাও। আরো একটি মামলায় আমি তাঁর বিপক্ষে ছিলাম। তিনি আপোষে বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমাকে আন্তরিক সহযোগিতা প্রদান করেন।ছোট বেলা যখন নিয়মিত বক্সীর হাটে বাজার করতে যেতাম ছগির চাচা এবং সিনিয়র এডভোকেট মাহাবুব উদ্দিন চাচাকে পাশা পাশি চেম্বার (হাকিম আলি রোড, নোটারী পাবলিক মরহুম এডভোকেট নবীদূর রহমানের বাড়ীর পাশে চেম্বার ও সপরিবারে বাস করতেন ।এর পর দীর্ঘ দিন ১ নং রহমতগঞ্জ, সাবএরিয়া এলাকায় সপরিবারে তিনি বসবাস করেন।পরবর্তীতে তিনি তাঁর মেঝ ছেলে সিডিএ-র ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ মঈনুদ্দি ইমন এর মেহেদীবাগস্থ স্টাফ কোয়াটারে চলে যান এবং মেহেদী বাগ জামে মসজিদে নিয়মিত জামাতে নামাজ ও এবাদত বন্দেগিতে রত থাকাবস্থায় মসজিদ সংলগ্ন কলোনিতে মেঝো সন্তানের বাসায় শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মৌলভী মো. ইছমাইল। ১৯৬৯ ইং তে তিনি চট্টগ্রাম জেলা বার এ যোগদেন। এর আগ পর্যন্ত তিনি দীর্ঘকাল আন্দরকিল্লায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এম.ই.এস হাই স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। আমি ঐ স্কুলের এসএসসি ১৯৮০ ব্যাচের প্রাক্তন ছাত্র। আমার পেশাগত জীবনে তিনি যখন সিডিএ( চ.উ.ক) এর আইন উপদেষ্টা ছিলেন তখন আমি তাঁর সাথে চউক এর প্যানেল এডভোকেট হিসেবে সিনিয়র থেকে অনেক কিছু শিখার সুযোগ পেয়েছি। সত্যিকার অর্থে তিনি একজন সৎ,আদর্শ, ন্যায়পরায়ন, পরহেজগার, পরোপকারী এবং আমাদের ভালো অভিভাবক ছিলেন।

আল্লাহ পাক তাঁকে ক্ষমা করে দিন, জান্নাতের উচু মাকামে স্থান দিন, আমিন।উল্লেখ্য বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালে দূ মাসের ব্যবধানে আমরা চাটগাঁবাসী ১৬জন বিশিষ্ট আইনযোদ্ধাকে হারিয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।মরহুম এডভোকেট আহমদ ছগির ছিলেন চট্টগ্রামের সর্বমহলে সমাদৃত একজন উদারমনা কর্মবীর।যতটুকু জানা যায় তাঁর জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া মহুকুমার অন্তর্গত জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে।১৯৩৮ সালের ৫ ডিসেম্বর সোমবার দিনটি ছিল তাঁর পৃথিবীতে আগমন দিবস। সাদা’র বংশের যে শাখাটি হজরত আবদুল গফুর সাদা’র হাত ধরে পটিয়ার নাইখাইন গ্রামের মল্লা পুকুর পাড়ে বসতি গড়ে তোলেন, তাঁদেরই উত্তর পুরুষ আহমদ ছগির। সাদা’র বংশ মোগল বংশ শাহ সুজা আরাকান যাওয়ার সময় মশালচি হিসাবে পথ দেখিয়ে আরকানে নিয়ে যান । পিতা মোহাম্মদ ইসমাইল সাদা, মাতা মজলিস খাতুন । তাদের পরিবারের নিকট প্রতিবেশি ও ঘনিষ্ট আত্মীয় কলকাতা ভেটেনারী কলেজের প্রিন্সিপ্যাল আব্দুল লতিফ ও ডাঃ আতাউল হাকিম ছিলেন । তারা উভয়ে সহোদর ।তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র থাকাবস্থায় পটিয়া থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসেন। মনের কোণে লালিত স্বপ্ন বিকশিত হতে হতে থাকে। ব্যারিষ্টার হবেন তিনি, এমনটাই লক্ষ্য থাকলেও শিক্ষাজীবন শেষে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। শহরের আন্দরকিল্লা নজীর আহমদ চৌধুরী লেন সংলগ্ন মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি কর্তৃক পরিচালিত এম ই এস উচ্চ বিদ্যালয়ে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম আইন কলেজ থেকে পড়াশোনা চালিয়ে এলএল.বি ডিগ্রি অর্জন করেন ও বার কাউন্সিল সনদ অর্জন করেন। এক সময় শিক্ষকতা পেশাকে বিদায় দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা বার সমিতিতে এডভোকেট তালিকাভূক্ত হন ১৯৭৬ সালে। জেলা বারে পুরোদমে আইনচর্চা শুরু করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবি সমিতিতেও তালিকাভূক্ত হন। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবি সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে এবং পরে ২০০১ সালে একই সমিতিতে সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। জেলা বারে আইনপেশা চর্চার চল্লিশ বছর পূর্ণ করা বার সদস্যদের মধ্যে তিনিও একজন। তিনি বরেণ্য আইনবিদ সাবেক রাষ্ট্রদূত ও চট্টগ্রাম জেলা বার এসোসিয়েশন এর সাবেক সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মরহুম এডভোকেট মোহাম্মদ ফয়েজের জুনিয়র ছিলেন। সিনিয়রের নির্দেশে ও বার এসোসিয়েশন এর তদানিন্তন সাধারন সম্পাদক এডভোকেট আলহাজ্ব এস এ মির্জা স্যারের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশন ভবনের ভূমির ঐতিহাসিক লীজ দলিলটির ড্রাফট তিনিই করেছিলেন। যার ভিত্তিতে আজ বার এসোসিয়েশন ভবনগুলো দন্ডায়মান। তাঁর সহধর্মিণীর নাম মিসেস আমাতুল হায়য়া বেগম। তিনি ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সীতাকুণ্ড এলাকায় একজন মাঠ পর্যায়ের সংগঠক ছিলেন। তিনি সীতাকুণ্ড উপজেলার ৪ নং মুরাদপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডস্থ মুরাদপুর গ্রামের ডাঃ ইউসুফ আলী মিয়াজি’র পৌত্রি এবং ইউসুফ আলী মিয়াজি’র একমাত্র পুত্র মরহুম তাজুল ইসলাম মাস্টারের একমাত্র কন্যা। মরহুম এডভোকেট আলহাজ্ব আহমেদ ছগির আংকেলের স্ত্রীর বড়ো ভাই মরহুম এডভোকেট মাহবুব সোবহান একজন বিশিষ্ট আইনবিদ ও নোটারি পাবলিক ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বারের একজন প্রথিতযশা সিনিয়র এডভোকেট ছিলেন।আহমদ ছগির চাচার জুনিয়রদের মধ্যে সিনিয়র এডভোকেট যথাক্রমে এস এম এবাদুল্লাহ্, মোঃ আজমল হক, জাফর আহমদ, দস্তগীর রেজা সিদ্দিকী, কল্লোল বড়ুয়া, অর্জুন বড়ুয়া, আবুল ফজল তালুকদার, ঈষিতা বড়ুয়া প্রমূখ এর নাম উল্লেখযোগ্য।পারিবারিক জীবনে আহমদ ছগির দূই পুত্র যথাক্রমে মহিউদ্দিন শিবলী ও মঈনুদ্দিন ইমন এবং এক কণ্যা রাহনুমা ফেরদৌসী ইনা প্রমুখ ০৩ সন্তানের জনক ছিলেন। প্রথম সন্তান শিবলী একজন সাহিত্যকর্মী ও সংগঠক, দ্বিতীয় সন্তান প্রকৌশলী আহমদ মঈনুদ্দিন ইমন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের প্রজেক্ট ডাইরেক্টর আর একমাত্র কণ্যা রাহনুমা ফেরদৌসী (ইনা) চট্টগ্রামের স্বনানধন্য ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন।

সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ততাঃ
এডভোকেট আহমদ ছগির যৌবনে নাট্য আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন বলেও ঘনিষ্টজন সূত্রে জানা যায়। বামপন্থী অর্থব্যবস্থা থেকে জাকাতভিত্তিক ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় অভিগমন ঘটে তাঁর। তমদ্দুন মজলিস ছিলো ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জনক সংগঠন। সেই সংগঠনের প্রাণপুরুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, সাপ্তাহিক সৈনিক সম্পাদক প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম ছিলেন তাঁর সুহৃদ শুভাকাঙ্ক্ষী এবং তাঁর ভাষাতেই ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব। মার্ক্সীয় দর্শন থেকে ইসলামী দর্শনে ফেরার পেছনে প্রিন্সিপ্যাল কাশেমের ভূমিকা তিনি নিজ জীবদ্দশায় প্রায়শ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন। তাঁর সাথে চট্টগ্রামের ঢাকা হাইকোর্টের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত এডভোকেট মরহুম মোফাক্কের যিনি দীর্ঘদিন তমদ্দুন মজলিশের শীর্ষ নেতা ছিলেন, তাঁর জামাতা সিলেটের শাহেদ আলির এবং সন্দ্বীপের প্রাক্তন এম পি এ কে এম রফিক ঊল্লাহ্ চৌধুরী সখ্যতা ছিলো ।ছগির চাচার বিচক্ষনতা, বুদ্ধিমত্তা ও সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। তিনি পদালোভী, ক্ষমতা লোভী, স্বীকৃতিলাভের ক্ষুধা কাতর ছিলেন না। লাইমলাইটে আসার স্বাভাবিক প্রবণতা তাঁর অভিধানে ছিলোনা।বড্ড স্পষ্টবাদী, নিরলস নির্ভিক নির্লোভ মানবিক চেতনা’র মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর ছিলো লক্ষ্য অর্জনে অবিচল প্রচেষ্টা। আইনপেশা তাঁর জন্য সোনায় সোহাগা হয়ে দেখা দেয়। এমনিতে এ পেশা সব পেশার যোগসূত্র বলে পরিচিত। তাঁর উন্নত মন-মানসিকতা ও সার্বিক কর্মকান্ড তাতে যোগ করে নুতন মাত্রা। ব্যাপক সাংগঠনিক দক্ষতা ও সীমাহীন খাটুনিতে অক্লান্তচিত্ত হওয়ায় শহরের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে তাঁর গড়ে ওঠে গভীর একাত্মতা। নগরীর সব দলমতের তৃণমূল থেকে শুরু করে শীর্ষপর্যায়ে গড়ে ওঠে তাঁর অসাধারণ সৎ ও পরিচ্ছন্ন ইমেজ। জাতীয় পর্যায়েও সৃষ্টি হয় বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা।সমসাময়িক চলমান ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাবলী ও তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো পরিস্কার। বিশ্বের নানা প্রান্তে তাঁর সময়ে ঘটে চলা রাজনৈতিক ঘটনামালা গভীর আগ্রহে অবলোকন করতেন তিনি। তখনকার মশহুর স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীগুলো সংগ্রহ এবং পাঠ করতেন সবিশেষ গুরুত্বের সাথে। ঐ সময়টাতে গোটা বিশ্ব আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটকেন্দ্রিক পশ্চিমা মেরু আর কমিউনিষ্ট সোভিয়েট ইউনিয়নের নেতৃত্বে ওয়ারশ জোট কেন্দ্রিক বাম মেরুতে বিভক্ত ছিলো। বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ন ঘটনা ঘটে ঐ সময়কালে। এসবের মধ্যে আফগানিস্তানে জামালউদ্দিন আফগানীর প্যানইসলামিজম মতবাদ প্রচার, মিশরে ইখওয়ানুল মুসলিমিন তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান আর ইরানে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় তাঁকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছিলো। এতো গেল বৈশ্বিক রাজনীতির কথা। তাঁর জাতীয় রাজনৈতিক জীবনও ছিলো বর্নাঢ্য। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, তিনি দীর্ঘ দিন ধরে অবদমিত থাকার একপর্যায়ে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। একসময় দেশে তিনি খালেছ ইসলামী দলের অনুসন্ধান করছিলেন। এদিকে ১৯৭৯ সালের ইরানী ইসলামী বিপ্লবের পর তিনি ইরানপন্থী হয়ে ওঠেন। এর পর ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেওবন্দপন্থী আলেম সমাজের অবিসংবাদিত নেতা হজরত মোহাম্মদুল্লাহ্ হাফেজ্জি হুজুর (রাহ্ঃ)-এর রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন নামের রাজনৈতিক সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মৃত্যূর পর তাঁর পুত্র মাওলানা আহমদুল্লাহ্ আশরাফ সংগঠনের একাংশের হাল ধরেন। অপর অংশের নেতৃত্বে আসেন হাফেজ্জী হুজুরের নায়েব শাইখুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক। এমতাবস্থায় ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে শায়কুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন, ভাসানী ন্যাপের একাংশ এবং একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠনের ইরান সমর্থক অংশ একত্রিত হয়ে জন্ম লাভ করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নামের একটি নতুন ইসলামী রাজনৈতিক দল। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন থেকে স্বেচ্ছাঅবসরে যাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত মরহুম এডভোকেট আহমদ ছগির ছিলেন সেই সংগঠন-এর চট্টগ্রাম জেলার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে জেলা আমীর এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সব সময় সত্যের অনুসন্ধানী ও আদর্শিক জীবনের অনুসারী ছিলেন। তিনি প্রথাগত সুন্নি মুসলমান পরিবারের সন্তান ছিলেন । তবে নানা প্রশ্ন মনে উঁকি দিতো তাঁর। বিশেষতঃ সুন্নী মতবাদে ইজতিহাদ বা স্বাধীন মতামতের সীমিত অস্তিত্ব, তকলীদ বা অন্ধ অনুকরণের বিষয়ের আধিক্য নিয়ে তাঁর কোনও আপত্তি ছিলো বলে জানা যায়নি। প্রচলিত সুন্নী তরিকায় স্বাধীন গবেষনার অস্তিত্ব থাকলেও যে কেউ গবেষক হতে এখতিয়ারবান নন। একজন মুজতাহিদ বা নতুন গবেষকের শ্বাশত প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও হানাফী ও ৪ ইমামের পর আর কোন মুজতাহিদ গত কয়েক শতাব্দিতে সুন্নীদের মাঝে দেখা যাচ্ছিল না, যা তাঁর সংবেদনশীল মনে ধরা পড়েছিল। অন্যদিকে ইরানে সংঘটিত শিয়া ইসনা আশারিয়া মতবাদভিত্তিক বিপ্লবে এসব বিষয়ে অধিকতর উদার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে আকৃষ্ট করে। তবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুন্নি হানাফী মাজহাবের প্রভাব ভুক্ত কওমী তরিকার প্রতিই আস্থাশীল ছিলেন তিনি।সহজ সরল জীবন দৃষ্টিভংগী ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ। তাঁর সহজ-সরল, অনাঢ়ম্বর সাদামাটা জীবন সম্পর্কে পরিচিতজন কমবেশি অবগত। তাঁর পরিধেয় অনেক বস্ত্র তিনি ছিঁড়ে না-যাওয়া অবধি পরিধান করে গেছেন। পাদুকাজোড়ার কোন কোনটি ছিলো ৪০ বছরেরও পুরাতন। তাঁর সঙ্গে আর একটি আবশ্যকীয় সঙ্গী ছিলো,তাঁর ছাতা। বন্ধুরা এটা নিয়ে খুব মজা করলেও রোদ-বৃষ্টিতে ওটা ছিলো তাঁর ঘরের বাইরের নিত্যসাথী। তাঁর উঁচুমানের ব্যক্তিত্ব ও রুচিবোধ সকলকে আকৃষ্ট করতো।সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলেও তাঁর ভেতর ছিলো উচ্চস্তরের ব্যক্তিত্ব,রুচিবোধ ও আত্মমর্যাদাবোধ। একবার তিনি গেলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ ব্যক্তি অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির সাথে দেখা করতে, পরনে সাদাসিধা পোষাক, সাথে সবসময়ের সাথী সেই কালো ছাতা। গেটে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মীদেরকে তিনি কিছু না বলে তাঁর একটি ভিজিটিং কার্ড দিলেন। সরলমনে তাঁকে গেটে দাঁড় করিয়ে একজন সেন্ট্রি ভেতরে গেলেন হেলে দুলে। ফিরে আসলেন ছুটতে ছুটতে। অসংখ্যবার ক্ষমা চাইলেন তাঁর কাছে। কারন নিজের নামপরিচয় কিছুই তিনি গেটে না বলায় সেন্ট্রিরা তাঁকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছিল। পরে যথাযথ সম্মানের সাথে তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ছিলেন জ্ঞানের খনি ও বইয়ের পোঁকা। তাঁর বড়ো সন্তান বিশিষ্ট সংগঠক ও সাহিত্যকর্মী মহিউদ্দিন শিবলী থেকে জানা যায়,তাঁর মরহুম পিতার সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে বহু অমূল্য গ্রন্থের সমাবেশ ছিলো। সাত শতাধিক বইয়ের সংগ্রহ তাঁর ৮২ বছরের জীবনকালে গড়ে তুলেছিলেন। মূল কোরআন ও তার বাংলা অনুবাদ ছাড়াও Marmaduke Pickthall-এর The Meaning of The Glorious Qur’an-এর মূলকপি, মুফতী মুহম্মদ শফি’র তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন-এর বাংলা অনুবাদের পুরো সেট, শাইখুল হাদীস মাওলানা আজিজুল হক কৃত বোখারী শরীফের বাংলা অনুবাদের পুরো সেট সহ অসংখ্য হাদীসগ্রন্থ, ইতিহাস, সাহিত্য, নাটক, গল্প, উপন্যাস, দর্শন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক নানা বই, এমনকি কার্ল মার্ক্সের On Religion, লিবিয়ার নেতা কর্নেল মুয়াম্মর আল গাদ্দাফীর The Green Book-এর ইংরেজী কপিও তাঁর লাইব্রেরিতে দেখেছি।মরহুম তাঁর জীবন সংগ্রাম,বেড়ে ওঠা ও জীবনলিপি নিয়ে একটি আত্মজীবনী মূলক রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তাঁর এ অসমাপ্ত আত্মজীবনী সমাপ্ত করার কঠিন কাজে হাত দিয়েছেন তাঁর বড়ো সন্তান মহিউদ্দিন শিবলী। এজন্য তাঁর পাঁচবছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে মর্মে তিনি জানালেন।আল্লাহ পাক তাঁকে তৌফিক দিন আমিন। আধ্যাত্মিক জীবনঃ তিনি অত্যন্ত পরহেজগার বুজর্গ আইনজীবী ছিলেন। তরবিয়ত খাঁ মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ ও কোর্ট হিল মসজিদে তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। প্রকৃত সত্যের পথ খুঁজছিলেন কৈশোর থেকেই। গত সহস্রাব্দের শেষ শতকের যে সময়টাতে তিনি সদ্য তরুণ, সোভিয়েট ইউনিয়নে তখন সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার। একজন সুন্নি মুসলিম হয়েও যৌবনে তিনি মার্ক্সের তত্ত্বজাত সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী অর্থব্যবস্থায় আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে ইসলামী অর্থব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। প্রথাগত সুন্নী পরিবারের সন্তান হয়েও নানান বিষয়ে অন্যান্য চিন্তাধারার সাথে পাঠপঠন ও সম্পৃক্ততা সৃষ্টি হয় তাঁর।তাঁর জৈষ্ট্য সন্তান আরো বলেন,”আমার বুদ্ধিবৃ্ত্তি বিকশিত হওয়ার পর থেকে তাঁকে খানিকটা সূফিতত্ত্ব গবেষনা,তরিকত ও মারেফত পন্থি হিসেবে দেখতে পেলেও জীবনের শেষ দিকে তিনি বিশুদ্ধ কওমী ধারায় আস্থাশীল হতে দেখি, নিভৃতচারী ধ্যানী তপস্যীর মতো সে পথেই কাটান বাকীটা জীবন”। ২০০৪-এ তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ২০০৭-এ হৃদযন্ত্রে বাইপাস সার্জারি করানো হয়। ২০১৭-তে সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পায়ে আঘাত পাওয়ার পর ক্রমশঃ শারীরিকভাবে দুর্বল হতে থাকেন। অবশেষে আজ থেকে ৪ বছর আগে ২০২০ সালের ২৩ জুনের এমন এক দিনে বেলা দশটার দিকে তাঁর ছোট ছেলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আহমদ মইনুদ্দিন ইমন এর সরকারি ফ্ল্যাটে ৮২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।আজকের দিনে তাঁর মতো আদর্শিক চেতনার মানুষের বড়ই সংকট।আল্লাহ পাক তাঁর নেক আমল সমূহ কবুল করুন, আমিন।

লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।

Scroll to Top