রাঙামাটি প্রতিনিধি: আইন প্রয়োগে উদাসীনতা ও যথাযথ নজরদারির অভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল পাবলাখালি রেঞ্জের মূল্যবান গাছ উজাড় বন্ধ হচ্ছে না। বন বিভাগের একশ্রেণীর অসাধু লোকজনের সহযোগিতায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ মদদে সবুজ বেষ্টনীর বিক্রয় নিষিদ্ধ গাছ-গাছালি কেটে প্রতিনিয়তই উজাড় করে দিচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংরক্ষিত বনাঞ্চলখ্যাত রাঙামাটির পাবলাখালী রেঞ্জ। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরেই অন্তত ১২টি স’মিল চালু রয়েছে। বন থেকে গাছ চুরি করে এসব স’মিলেই চিড়াই করে নৌ-পথে বিভিন্ন স্থানে পাচার করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
দীর্ঘ দেড় যুগ সময় ধরে আঞ্চলিক দলগুলোর বাধার মুখে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুনভাবে বনায়ন না হওয়ায় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট চক্র কর্তৃক প্রতিনিয়ত গাছ চুরির পাশাপাশি সংরক্ষিত বনের ভেতরেই চিড়াই কাঠের স’মিলের নিয়মিত গ্রাসে বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছে পাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চল গুলো।
সম্প্রতি পাবলাখালীতে সরেজমিনে গেলে খোদ বনবিভাগের লোকজন অকপটেই স্বীকার করে জানিয়েছেন, যেখানে নিজের প্রাণ নিয়েই বেচেঁ থাকা কষ্টকর হয়ে উঠে সেখানে গাছ চোর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়বো কিভাবে। অস্ত্রতো দূরের কথা, নিজেদের জরুরী মুহুর্তে চলাচলের জন্য একটি মোটর সাইকেল, নৌকা পর্যন্ত নেই, থাকার কোনো ভালো বাসস্থানও নেই। স্থানীয় চোর চক্র, আঞ্চলিকদলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের উৎপাতে এক প্রকার ঘরের কোনে কোনো রকম নিজেদের লুকিয়ে রেখে প্রাণ নিয়ে বেচেঁ থেকেই দায়িত্বপালন করছে পাবলাখালি রেঞ্জের বনবিভাগের লোকজন।
স্থানীয় বাসিন্দা জানিয়েছেন, মূলতঃ কাপ্তাই হ্রদের পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঠ চোরাকারবারি সিন্ডিকেট চক্র আরো বেপরোয়া হয়ে ইলেকট্রিক করাতের সাহায্যে স্বল্প সময়ের মধ্যেই মূল্যবান গাছগুলো কেটে হ্রদের পানিতে ফেলে দেয়। পরে সেগুলোকে বিশেষ ব্যবস্থায় টেনে নিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নেয়। এরপর বনবিভাগের বিশেষ সিল ব্যবহার করে গাছগুলোকে পারমিটের গাছের সাথে মিশিয়ে বাজারজাত করে চিহ্নিত কাঠ ব্যবসায়িরা। এই ক্ষেত্রে বনবিভাগের একশ্রেণীর কর্মচারি সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবলাখালি রেঞ্জের অধীনস্থ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরেই অন্তত ১২টি স’মিল চালু রয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিজস্ব মালিকানাধীন এসব স’মিলে প্রতিদিনই শতশত ঘনফুট গাছ চিড়াই করা হয়। এ সকল স’মিলে প্রতিদিনই কয়েক লাখ টাকার চোরাই কাঠের ব্যবসা চলে।
সরেজমিনে পাবলাখালির বনাঞ্চলে গেলে সেখানের স্থানীয়দের কাছ থেকে একটি অডিও ক্লীপ প্রতিবেদকের হাতে আসে। সেই অডিওটিতে বনবিভাগের জনৈক কর্মচারিকে বলতে শোনা যায়, “ভাই আমার ৫০ হাজার টাকার দরকার, বাগানের ভেতরে সেগুন গাছ যা আছে সব কাইট্টা লান, আগে ঠাইলডি কাইট্টা নামাইয়া লাইবেন, পরে গাছ সাইজ কইরালাইবেন। কেউই যাইবোনা, আমি না গেলে কেউই যাইবো অইখানে, ঠিক আছে। আমি মামলা নাদিলে কেউই দিতে পারবোনা এইডা মনে রাখবেন। আমার অনেক টাকার কাম, ৫০ হাজার টাকা লাগে, পোলাপাইন লাগাইয়া দেন, কয়েকটা গাছ বেইচ্ছালান”। …..ল ্্ওই যে, খালের সাইট থেকে কাইট্টা খালে দিয়া নৌকা দিয়ে লইয়া যাইবাগা………………….।
বিয়ষটি নিয়ে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী পাবলাখালী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ চুরির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সেখানে আমরা আমাদের কর্মীদের একটি মোটর সাইকেলও দিতে পারিনি, বোট থেকে শুরু করে অন্য কোনো ভেহিকেল নাই। অনেক পানিপথ আছে যাওয়া যায়না। তারপরও কিছুদিন আগে সেখানে যে কয়েকটি গাছ অবৈধভাবে কাটা হয়েছিলো, সে ব্যাপারে আমরা মামলা করেছি এবং আমাদের একজন ষ্টাফের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ায় তার বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। নিজেদের রক্ষায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না থাকায় রাত্রে বেলায় ফরেষ্টের লোকজনের চলাচল সীমিত রাখা হয় মন্তব্য করে বিভাগীয় বনকর্মকর্তা বলেন, রাত্রে বেলায় অনেক সময় গাছ কেটে নিয়ে যায় চোরাকারবারিরা। এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের ষ্টাফদের জন্য খুবই দুরূহ।
এই অভয়ারণ্যটিকে বাঁচানোর জন্য পাবলাখালী রেঞ্জের বাপার জোনকে উদ্ধার করে সেখানে বনায়নের কোনো বিকল্প নেই মন্তব্য করে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতিতে আমাদের বনবিভাগের লোকজনকে অস্ত্র দিচ্ছে না। এছাড়াও আগুন দিয়ে ফরেষ্ট অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়, বেদখল হয়, সেখানে অবস্থান করে আমার লোকজন অস্ত্র কিভাবে রাখতে পারবে সেটিও ভেবে দেখার বিষয়।
কাপ্তাই হ্রদের পানি বেষ্টিত সুবিশাল এলাকাজুড়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে পরিচিত পাবলাখালীর সংরক্ষিত বন সম্পর্কে ১৯৫৪ সালের এক জরিপে প্রথম তথ্য পাওয়া যায়। সেসময় ২,৫৪০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কাচালং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি অংশ ছিল পাবলাখালী এবং এর বিস্তৃতি ছিল প্রায় ৪৫০ বর্গকিলোমিটার। পরবর্তীতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে এই বনের অনেক এলাকা হ্রদের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং বনের আয়তন কিছুটা সংকুচিত হয়।
১৯৬২ সালের জুন মাসে বন্যপ্রাণী আর প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের জন্য এটিকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র বা গেইম রিজার্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর এটিকে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে রাঙামাটি শহর থেকে ১১২ কিলোমিটার দূরে কাপ্তাই হ্রদের একেবারে উত্তর প্রান্তে কাচালং নদীর পাশে অবস্থিত পাবলাখালী রেঞ্জ তথা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। পাবলাখালি রেঞ্জের প্রায় ৬০ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমির মধ্যে ৪৫ হাজার একর পাবলাখালির বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য বলে জানিয়েছে রাঙামাটির উত্তর বনবিভাগ কর্র্তৃপক্ষ। যেখানে হাতিসহ প্রায় কয়েক হাজার প্রজাতির বন্যপ্রাণী আর পাখির বসবাস রয়েছে বলে বনবিভাগ সূত্র জানিয়েছে।