আরমানুর রহমান : আবদুল গফুর হালী। চট্টগ্রামের লোক ও সুফি সঙ্গীতের কিংবদন্তী এই গফুর হালী। যার অমর সৃষ্টি নিয়ে, যার জীবন গাঁথা নিয়ে গবেষণা করেছেন আমেরিকা, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের বরেণ্য লোকসাহিত্য গবেষকরা। যার লেখা গান গেয়ে একেবারে তৃণমূল শিল্পী থেকে রাতারাতি জাতীয় তারকা হয়ে উঠেছেন অনেকেই, যে গফুর হালী শত শত শিল্পী, গবেষক তৈরির কারিগর। যে গফুর হালীর গান মানুষের অন্তরাত্মা খুলে দেয়। যার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে মনের অন্ধকার। আজ ২১ ডিসেম্বর সেই গফুর হালীর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালের এই দিনে এই মহান লোক সাধকের মৃত্যু হয়।
অথচ এমন মরমী মহাপুরুষের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা বাঙ্গালি কেমন যেন নিশ্চুপ, নির্বিকার। এই মহাসাধকের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর গ্রামের বাড়ি পটিয়ার রশিদাবাদ গ্রামস্থ বাগে ভাণ্ডারী দায়রা শরীফে পারিবারিক উদ্যোগে কর্মসূচি পালিত হয়েছে মাত্র। অথচ এই কীর্তিমানের প্রয়াণ দিবস এমন নিরবে নিভৃতে চলে যাবে – এমন তো কথা ছিল না! তাই হয়ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- “দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু/ দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু। ”
লোক সাধক আবদুল গফুর হালী ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার এক মানুষ। তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, শিল্পী, সুরকার, সংগীত পরিচালক, যন্ত্র শিল্পী এবং নাট্যকার। তাঁর কালজয়ী গান গেয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, কল্যাণী ঘোষ,মাইজভান্ডারী তরিকার বিখ্যাত শিল্পী সেলিম নিজামী ও শিমুল শীল বড় হয়েছেন। হাল আমলের রবি ঘোষ, শিরিন, পারভেজসহ অসংখ্য শিল্পী এই গফুর হালীর কালজয়ী গান গেয়ে তারকা হয়েছেন। এই গফুর হালীর হাত ধরে, হাতে খড়ি নিয়ে দেশের অসংখ্য শিল্পী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। কিন্তু প্রয়াণের মাত্র সাতটি বছর না পেরুতেই গফুর হালীর মত একজন যুগস্রষ্টা চলে যাচ্ছেন মনের আড়ালে। আমরা ভুলে যাচ্ছি গফুর হালীকে। কিন্তু আমরা ভুলে গেলেও গফুর হালীরা বেঁচে থাকেন তাঁদের সৃষ্টিতে। তাঁদের সাধনায়।
গফুর হালীকে নিয়ে গবেষণা করতে ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার রশিদাবাদ গ্রামে আসেন ‘জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক’ ‘হানস হারডার’। গফুর হালীর মাইজভাণ্ডারী গান নিয়ে হার্ডার প্রকাশ করেছেন তার গবেষণাগ্রন্থ ‘ডার ফেরুখটে গফুর স্প্রিখট’। বিশ্ববরেণ্য সামাজিক নৃবিজ্ঞানী ড. পিটার বার্টুসি গফুর হালীর গান নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। আমেরিকার এমোরি ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর ড. বেঞ্জামিন ক্রাকাউর গফুর হালীর গান নিয়ে গবেষণা করছেন। চট্রগ্রামের লেখক ও গবেষক শামসুল আরেফীন তার ‘বাঙলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য ২য়-৪র্থ খণ্ডে’ গফুর হালী সম্পর্কে তার লব্ধ তথ্য উল্লেখ করেছেন।
সুফি মিজান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এবং পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক আনোয়ারুল হক চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় আবদুল গফুর হালীর ৩০০ গানের স্বরলিপিসহ গীতিাকাব্য ‘সুরের বন্ধন, শিকড় ও দিওয়ানে মাইজভাণ্ডারী’ এবং নাটক সংগ্রহ ‘আবদুল গফুর হালীর চাটগাঁইয়া নাটকসমগ্র’ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১০ সালে গফুর হালীকে নিয়ে নির্মিত হয় প্রামাণ্য চলচ্চিত্র “মেঠোপথের গান”।
আবদুল গফুর হালী ১৯২৮ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার রশিদাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম আবদুস সোবহান এবং মাতার নাম গুলতাজ খাতুন। রশিদাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও জোয়ারা বিশ্বম্বর চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। তবে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত একাডেমিক শিক্ষা অর্জনের পর তিনি আর পড়ালেখা করেন নি।
গফুর হালীর গানে রয়েছে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। আর তার উপর সে ছোঁয়া লেগেছে মাইজভান্ডারি দর্শন থেকে। গফুর হালী ছিলেন আস্কর আলী পণ্ডিত, মাওলানা বজলুল করিম মন্দাকিনী, মাওলানা আবদুল হাদি কাঞ্চনপুরী এবং রমেশ শীলের মতো মাইজভান্ডারী সুফি সাধকদের ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি। লোক, সুফি, মারফতি, মুর্শিদী, মাইজভান্ডারী ঘরানায় প্রায় দুই হাজারেরও অধিক গানের রচয়িতা গফুর হালী।
বাংলা লোকজ সুফি ঘরানার মহান পুরুষ আবদুল গফুর হালী নিরবে শায়িত আছেন তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ার রশিদাবাদ গ্রামে। ।
চাটগাঁ নিউজ/ইউডি