চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দর বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছেন অনেকেই। সারাবিশ্বে চলা এ সংকটের ব্যতিক্রম নয় বাংলাদেশও। গত ডিসেম্বরে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ১০ শতাংশের নিচে আসলেও এসময়ে বেড়েছে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি। এসব বিবেচনায় এখন বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। ফলে সংকট থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে না সরকার। এতে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া কমলেও আগের ঋণ ও সুদ পরিশোধের চাপ থেকেই যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, সদ্য বিদায়ী বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২০৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণাত্মক। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রের ঋণ ও সুদ পরিশোধের চেয়ে এই সময়ে কম বিক্রি হয়েছে। অথচ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই ও আগস্টে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছিল। প্রথম মাস জুলাইয়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। পরের মাস আগস্টে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে নিট বিক্রি ফের ঋণাত্মক ধারায় ফেরে। মাসটিতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকার যে পরিমাণ ধার করেছিল, তার চেয়ে ১৪৮ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করতে হয়েছে সুদ পরিশোধে।
তথ্য বলছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় (জুলাই-ডিসেম্বর) মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা ঋণাত্মক। অর্থাৎ আলোচিত সময়ে যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে বেশি আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে সরকার। অতিরিক্ত অর্থ কোষাগার অথবা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে।
অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে ধরা হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ‘ঋণ’ নিতে পারেনি সরকার।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোসহ কড়াকড়ি আরোপের কারণে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। এ কারণে নিট বিক্রি নেগেটিভ হয়েছে। অপরদিকে সরকারকে কোষাগার বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সুদ-আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ শর্ত দিয়েছে ২০২৬ সালের মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে আনা। তাছাড়া সরকারও অধিক সুদে ঋণ নিতে চাচ্ছে না। এ কারণে এখন নতুন ঋণ না নিয়ে আগের ঋণ পরিশোধে মনোযোাগী সরকার।
যেসব শর্ত সঞ্চয়পত্রে
বর্তমানে ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে আয়কর রিটার্নের সনদ দাখিল বাধ্যতামূলক। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। তার আগে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেজ তৈরি হয়।
দেশে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এছাড়া পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হলেও এখনো ব্যাংকের তুলনায় বেশি।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্য কমিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। তবে অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে এক টাকাও ঋণ পায়নি সরকার। বিপরীতে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধ এবং ভাঙানো বাবদ ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল সরকার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিট ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার নিট ঋণ নেয় ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হয় ৪১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ১৯ হাজার ৯১৬ কোটি টাকার নিট ঋণ নিয়েছিল।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ