চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : ছেলের ছাগলকাণ্ডের পর দুর্নীতির লাগামহীন অভিযোগের তীরে বিদ্ধ হচ্ছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মতিউর রহমান। অনেকে তো এরই মধ্যে তাঁকে রাজস্বের ‘কালো বিড়াল ‘ হিসেবে তকমা দিতেও কসুর করছেন না। সরকারি এই কর্মকর্তার বিপুল অবৈধ সম্পদের খবরে সয়লাব হয়ে গেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশিরভাগ সংবাদপত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও কম যায় না। সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত অনুসন্ধানেও পাওয়া যাচ্ছে চমকপ্রদ সব তথ্য। আর এতেই সাধারণ মানুষের চক্ষু যেন চড়কগাছ! উঁচু গর্দানওয়ালা ছাগলের ছবি দিয়ে ছেলেই যেন দুদকের কাছে ‘পিতৃত্ব অস্বীকারকারী’ পিতার গর্দান উন্মুক্ত করে দিলো।
কেঁচো খুঁড়তে অনেকটা রাসেল ভাইপারস বেরিয়ে আসার মতো পরিস্থিতিতে এনবিআর এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্তে অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। সম্প্রতি দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মইনউদ্দীন আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে কমিশন সভায় এনবিআর সদস্য (শুল্ক ও আবগারি) ড. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যেই দুদকের কর্মকর্তারা মাঠে নেমেছেন।
দুদক সূত্র জানায়, এর আগে মতিউরের বিরুদ্ধে কমিশনে চারবার দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছিল। কিন্তু নথিভুক্তির মাধ্যমে এসব অনুসন্ধানের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে তাঁকে “ক্লিনচিট ” দেয় দুদক। তবে এবার কমিশন অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ঈদুল আজহার জন্য ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হন কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমান ইফাত নামের এক তরুণ। পরে জানা যায় ভাইরাল ইফাতের বাবা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য ড. মতিউর রহমান। ছেলের ছাগলকাণ্ডে নিজেকে রক্ষা করতে তিনি বলেন, ইফাত তাঁর ছেলে নয়। পরে জানা গেছে, ইফাত তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। এদিকে কানাডায় তাঁর মেয়ের ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যার দাম প্রায় ৪ লাখ কানাডিয়ান ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা। একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন প্রশ্ন উঠেছে নেটিজেনদের মাঝে ।
দুদকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়,মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য রয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, ব্যাংকে নগদ অর্থ, মেয়াদি আমানতসহ সবকিছুই আছে তাঁর নামে। অনুসন্ধানে মতিউর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
দুদক সূত্রে জানা যায়,ঢাকায় মতিউর রহমানের স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠদের নামে ২ ডজন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। বসুন্ধরার ডি-ব্লকের ৭/এ রোডের ৩৮৪ নম্বর ভবনের মালিক তিনি। সাততলা ভবনের প্রথম, দ্বিতীয় তলায় স্ত্রী লায়লা কানিজকে নিয়ে বাস করেন। গুলশানের সাহাবুদ্দিন পার্কের পাশে ৮৩ নম্বর রোডের ১১ নম্বর প্লটে আনোয়ার ল্যান্ডমার্কের বেগ পার্ক ভিউতে রয়েছে ৪টি ফ্ল্যাট। কাকরাইলে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে ছোট স্ত্রীর নামে। এ ছাড়া ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে একাধিক ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ডেভেলপার কোম্পানি শান্তা ডেভেলপারের করা বিভিন্ন ভবনে তাঁর ৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ফ্ল্যাট প্রথম স্ত্রীর সন্তান ফারজানা রহমান ঈপ্সিতা ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের নামে কেনা হয়েছে।
এছাড়াও ময়মনসিংহের ভালুকার হবিরবাড়ি ইউনিয়নে প্রায় ৩০০ বিঘা জমিজুড়ে তাঁর মালিকানাধীন গ্লোবাল শুজ লিমিটেড নামে জুতার ফ্যাক্টরি আছে। জুতার ফ্যাক্টরিতে প্রায় ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারি কর্মরত। এ ফ্যাক্টরির উৎপাদিত জুতা রপ্তানি হয় বিভিন্ন দেশে। এছাড়া সাভার থানার বিরুলিয়া মৌজায় আটটি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ এবং একই মৌজায় স্ত্রীর নামে ১৪.০৩ শতাংশ জমি রয়েছে। গ্লোবাল সুজ কোম্পানির নামে সাতটি খতিয়ানে ৬০ শতাংশ জমি রয়েছে। এর মূল্য প্রায় ৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে টঙ্গীতে ৪০ হাজার বর্গফুটের এসকে ট্রিমস নামে ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাক্সেসরিজ কারখানা আছে তাঁর। এছাড়া মতিউরের নিজ এলাকা মুলাদী উপজেলায় বাড়িঘর ছাড়াও তাঁর নামে প্রায় ১ হাজার ৫০০ বিঘা জমি রয়েছে।
অন্যদিকে নরসিংদীর মরজালে তাঁর স্ত্রী উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকির নামে ১০০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট। তাঁর মেয়ে ফারজানা ঈপ্সিতার নামে মরজাল বাসস্ট্যান্ড ও আশপাশ এলাকায় ১০ বিঘা জমি রয়েছে। পূবাইলের খিলগাঁওয়ের টঙ্গী-ঘোড়াশাল সড়কের দক্ষিণ পাশে ২০১৮ সালে প্রায় ২৫ বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন ‘আপন ভুবন’ পিকনিক অ্যান্ড শুটিং স্পট। এছাড়া ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও মেয়ে ঈপ্সিতার নামে ৫০ বিঘা জমি রয়েছে। নাটোরের সিংড়ায় ২০ বিঘা জমি রয়েছে। স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির নামে নরসিংদীর রায়পুরার মরজালে ৪ বিঘা জমির ওপর রয়েছে অট্টালিকা। এছাড়া গাজীপুর সদর, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় ৬০ শতাংশ জমি আছে। সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় ১২ দশমিক ৫৮ শতক জমি রয়েছে। লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়ায় ১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ জমি রয়েছে মতিউরের। মতিউর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রাডো, বিএমডব্লিউ, রেঞ্জ রোভারসহ বিলাসবহুল ৮ থেকে ১০টি গাড়ি আছে তাদের। তবে প্রায় সব গাড়ির মালিকানা তাদের বিভিন্ন কোম্পানির নামে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায় নি ।
উল্লেখ্য , মতিউর রহমানের ডাক নাম পান্নু। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের মুলাদী উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স করার পর এমবিএ করেন। ১৯৯০ সালে চাকরি নেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনে। ১৯৯৩ সালে ১১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কাস্টমসে যোগ দেন এবং ২০১৫ সালে কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনারসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনালের (সিইভিটি) প্রেসিডেন্ট। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে যুগ্ম কমিশনারের দায়িত্বে থাকাকালে শুরু হয় তাঁর উত্থান। বর্তমানে তিনি এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
চাটগাঁ নিউজ/এসআইএস