নিজস্ব প্রতিবেদক : গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর হামলা, সংঘর্ষ ও হত্যার অভিযোগে দায়ের হচ্ছে একের পর মামলা। প্রতিটি মামলায় আসামির তালিকা অতি দীর্ঘ। একেকটি মামলায় কমপক্ষে ৩০ থেকে হাজার সংখ্যক আসামিও রয়েছে।
তবে মামলাগুলোতে আসামির তালিকায় ঘটনা সংশ্লিষ্টদের চেয়ে ঘটনায় জড়িত নয় এমন লোকজনের সংখ্যা বেশি- এমন অভিযোগ উঠেছে।তাই ঘটনা বহির্ভুত লোকজনকে মামলাভুক্ত করার কারণে একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যেমন প্রকৃত আসামি নির্বাচন করতে বেগ পেতে হচ্ছে, তেমনি ঘটনা বহির্ভুত ব্যক্তি বিশেষকে মামলায় অভিযুক্ত করার কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছে শত শত নিরপরাধ ব্যক্তিবর্গ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে পুঁজি করে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ চরিতার্থ করা এসব মামলা দায়েরের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করছেন দেশের সচেতন নাগরিকরা।
চাটগাঁ নিউজের অনুসন্ধানেও এমন একটি মামলা পাওয়া গেছে। যেখানে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের পাশাপাশি রয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা। আবার কেউ কেউ ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ করলেও ঘটনাস্থলে না থেকেও হচ্ছেন মামলার আসামি। ফলে এক প্রকার হাস্যরসের জন্ম দিচ্ছে নামে বেনামে করা এসব মামলা, হারাচ্ছে গ্রহণযোগ্যতা।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন গত ১৬ জুলাই পাঁচলাইশ থানাধীন চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সের সামনে সড়ক এলাকায় হত্যার উদ্দেশ্যে ধারালো অস্ত্রের দিয়ে গুরুতর জখম, ককটেল বিষ্ফোরণ ও সহিংসতার অপরাধের অভিযোগে ২৪ সেপ্টেম্বর পাঁচলাইশ মডেল থানায় মো. মিনহাজুর রহমান নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী একটি মামলা দায়ের করেন। যে মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ৩৩ জনকে । যাদের মধ্যে ৩২ জনই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী থাকলেও সাবেক ছাত্রদল নেতা সালাউদ্দিন কাদের মানিকের নামও রয়েছে। যার সাথে বাদির কোনো যোগসূত্র নেই। এমনকী ঘটনার সাথেও তার নূন্যতম সম্পৃক্ততা নেই এমনটি দাবি মামলার ২৩ নম্বর আসামি সালাউদ্দিন কাদের মানিকের।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আমি মিনহাজুর রহমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অনার্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের একজন ছাত্র। ১৬ জুলাই আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-জনতার সাথে যোগদান করেছিলাম। ওইদিন আনুমানিক বিকাল ৪টার সময় মামলার ১-৩৩ নং বিবাদীগণ তাদের সহযোগী অজ্ঞাতনামা আরো ১০০-১৫০ জন বিবাদীগণের হাতে থাকা বন্দুক, রিভলবার, হকিস্টিক, রড, ককটেলে সজ্জিত হয়ে বিবাদী রেজাউল হক রুবেল, মনসুর আলম, রাকিবুল হাসান দিদার, ইরফাতুল আলম পিটু আতঙ্ক সৃষ্টি করে অপরাধ সংঘটিত করে। তারা ছাত্র জনতাকে এলোপাতাড়ি লোহার রড ও হকিস্টিক দিয়ে জখম করে। এক পর্যায়ে রেজাউল হক রুবেল আমাকে চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সের পাশে এস এ পরিবহন অফিসের সামনে রাস্তার উপর তার হাতে থাকা রামদা দিয়ে মাথায় কোপ মারে। আমি হাত দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করায় আমার বাম হাতের কব্জির নিচে লাগিয়া গুরুতর জখম হয়। তারপর মনসুর আলম, রাকিবুল হাসান দিদার এবং ইরফাতুল আলম পিটুসহ সকল বিবাদীরা লোহার রড, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে আমাকে বুকে, পিঠে, হাঁটুতে এবং কোমরে পিটাইয়া গুরুতর জখম করে।
তবে এজাহারে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের মানিকের সম্পৃক্ততা নিয়ে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। জানা গেছে, তিনি ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম আইন কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সহ-সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। একই কলেজে তিনি ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া মানিক ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম আইন কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মনোনীত নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
জানতে চাইলে সালাউদ্দিন কাদের মানিক চাটগাঁ নিউজকে বলেন, আমি ঘটনায় কোনোভাবেই জড়িত নয়। তাছাড়া আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন কর্মী। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে আমাকে এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমি এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সঠিক বিচার বিশ্লেষণ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাই।
সাম্প্রতিক সময়ে দায়েরকৃত এসব মামলাগুলোতে নিরপরাধ ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন খোদ বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘যারা সত্যিকার অর্থে ঘটনায় জড়িত, তাদের আসামি করলে মামলা শক্ত ও তদন্ত করা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে মামলায় সাংবাদিক, পুলিশ, বিজিবি, ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের আসামি করা হয়েছে। আমরা পুলিশকে বলেছি, থানায় মামলা রেকর্ড করার আগে যাচাই-বাছাই করে দেখে নেওয়ার জন্য।’
তিনি আরও বলেন, মামলা হলে যে গ্রেফতারের আওতায় আসবে তা নয়। কেউ যদি সত্যিকার অর্থে জড়িত হয়, তা হলে তাকে গ্রেফতার করা যাবে। নিরীহ কাউকে যদি আসামি করা হয়, সেটা যাচাই-বাছাই হবে। সুতরাং এটা নিয়ে ভীত হওয়ার কারণ নেই। প্রতিটি মামলা বিশ্লেষণ করে আমরা পৃথক তদন্ত কমিটি করেছি।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সোলায়মান বলেন, কোন নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে মামলাভুক্ত হয়ে হয়রানির শিকার না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার বিএনপি-জামায়াত নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভেরিফাই করার জন্য। তবুও নিরপরাধ কেউ মামলাভুক্ত হলে আমরা যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নিবো।
চাটগাঁ নিউজ/উজ্জ্বল/জেএইচ/এসএ