নিজস্ব প্রতিবেদক : বর্ষা আসতে না আসতেই চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিষধর সাপ রাসেল’স ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে গুজব, উদ্বিগ্ন। মানুষের এই উদ্বেগের আগুনে অনেকটা ঘি ঢালার মতো কাজ করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু গুজব। এই গুজব ছড়িয়ে পড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরাও।
রাসেল’স ভাইপার কী ধরনের প্রাণী ও এটিকে কিভাবে সহজে চেনা যায় তা নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় চাঁটগা নিউজকে বলেন, ভাইপারিডি গোত্রের কয়েক প্রকার সাপ বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এর মধ্যে রাসেল’স ভাইপার অন্যতম। রাসেল’স ভাইপার অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল। এটা একটু পেট মোটা টাইপের সাপ। এর মাথাটা চিকন আকৃতির। শরীরে মধ্যে কোয়েলের বা শিকলের মতো প্যাঁচানো ছোপ ছোপ চিহ্ন থাকে।তবে এই বর্ণনা শুনে রাসেল’স ভাইপার মনে করে ধরে ফেলা উচিৎ না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া রাসেল’স ভাইপার নিজ থেকে মানুষকে আক্রমণ করে। এটি কামড় দিলেই মৃত্যু- এসব বিষয়ে তিনি আরও বলেন, সৃষ্টির কোন প্রাণী বিনা কারণে কাউকে আঘাত করে না। কিছু কিছু সাপের ব্যাপারে বলা হলেও রাসেল’স ভাইপার ওই ধরনের সাপ না, ওর গায়ের উপর পরলেই কেবল কামড় দেয় আত্মরক্ষার জন্য।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে রাসেল’স ভাইপারের উৎপাত আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে আমাদের অনেক পুরনো একটা দলিল আছে , যেখানে বলা হযেছে বাঁশখালিতে পাওয়া গিয়েছে। সেটা বহু বছর আগের। এর পর আমরা কখনো চট্টগ্রামে রাসেল’স ভাইপার দেখি নাই। গতবছর আমরা ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম, সীতাকুণ্ড বা মীরসরাইয়ের যে বীচ সেখানে একজন ব্যক্তি রাসেল’স ভাইপার দেখে ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড করেছেন। আমরা পোস্টটি দেখে যোগাযোগ করেছি, সেখানে গিয়ে পরেরদিন তা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভিডিও দেখে মনে হয়েছে তা রাসেল’স ভাইপার। আমাদের ধারণা হচ্ছে. এটি পদ্মা গঙ্গা অববহিকা দিয়ে মোহনা হয়ে জলে ভেসে কোন কারণে এখানে এসেছে। আমাদের চট্টগ্রামে রাসেল’স ভাইপার নেই। তবে চট্টগ্রামে ভাইপার আছে তা হলো রিড় ভাইপার। এর কামড়ে অনেক রুগী আসছে।
রাসেল’স ভাইপার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর বিষয়ে এ গবেষক চাঁটগা নিউজকে বলেন, গুজবে কান দেওয়া যাবে না। চিলে কান নিয়ে গেছে তা নিয়ে চিলের পেছনে না দৌঁড়ানো উচিত। নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম থেকে সংবাদ গ্রহণ করে সচেতন হওয়া উচিত।
বেসরকারি সংস্থা ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন বলছে রাসেল’স ভাইপার মোটেও দেশের সবচেয়ে বিষধর কিংবা প্রাণঘাতী সাপ নয়। বরং দেশে প্রতি বছর সাপের কামড়ে যত লোক মারা যায় তার অর্ধেকই মারা যায় পাতি কেউটে সাপের কামড়ে। তবে সময়মত চিকিৎসা না নিলে রাসেল’স ভাইপারের কামড়েও মৃত্যু হতে পারে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসেবে ২০২৩ সালে চার লাখ সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাড়ে সাত হাজার মানুষ মারা গেছে যাদের বেশিরভাগই কোবরা ও কেউটে প্রজাতি সাপের কামড়ের শিকার হয়েছেন। তবে রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে ঠিক কতজন মারা গেছে তার সুনির্দিষ্ট হিসেব পাওয়া যায়নি। সাপের কামড়ে আক্রান্ত রোগীকে যত দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা যায় ততই মঙ্গল। তাই সাপে কামড় দিলে সময় নষ্ট না করে নিকটস্থ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে স্থাপিত বৃহত্তম ভেনম রিসার্চ সেন্টারে তৈরি হয় বিষধর সাপের প্রতিষেধক। বিদ্যমান এন্টিভেনম ভ্যাকসিন দিয়েও বর্তমানে আলোচিত রাসেল’স ভাইপারে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। বর্তমানে সেখানে রাসেল’স ভাইপারসসহ চার ধরনের সাপ থেকে বিষ নিয়ে এন্টিভেনম তৈরি করা হচ্ছে। তবে ৫০টি রাসেল’স ভাইপার সাপের বিষ নিয়েও এন্টিভেনম তৈরির পৃথক একটি গবেষণা চলছে।
দেশের মানুষ বরাবরই বন্যপ্রাণীদের নিছক উপদ্রব মনে করে আসছে। কোথাও ঠান্ডা মাথায়, কোথাও দলবেঁধে মহা উল্লাসে ওদের হত্যা করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এই অবস্থা চলার ফলে প্রকৃতি এখন প্রায় বন্যপ্রাণীশূন্য। এ অবস্থায় হঠাৎ কোনো প্রাণীর উত্থান, বৃদ্ধি, কিংবা উপদ্রব যাই বলি না কেন এ হচ্ছে আসলে প্রকৃতির এক ধরনের প্রতিশোধ। বন্যপ্রাণী হত্যা করে মানুষ নিজেই নিজের বিপদ ডেকে এনেছে। এজন্য বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, সর্প বিশারদ, সাপ উদ্ধার কর্মীসহ সকল সচেতন নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে।
চাটগাঁ নিউজ/এআইকে/এসএ