নিজস্ব প্রতিবেদক : পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন আসমা-মাসুদ (ছদ্মনাম)। ১২ বছরের দাম্পত্য জীবনে আসে এক মেয়ে সন্তান। এর মধ্যে পরকীয়ায় জড়ান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাসুদ। প্রতিবাদ করতেই আসমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন। কয়েক বছর অপেক্ষা করেও যখন স্বামীকে সংসারমুখী করতে পারলেন না তখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন আসমা। মেয়েকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান। স্বামীকে দেন তালাক। সোনার সংসার ভেঙে তছনছ।
আসমা-মাসুদের মতো নগরীতে দিনে ২০ জনের সংসার ভাঙ্গছে। পরকীয়া, স্বামী মাদকাসক্ত, যৌতুক নিয়ে দ্বন্দ্ব, মেয়ে সন্তান জন্মদানে অসন্তুষ্টি, মতের অমিল, স্বামী-স্ত্রীর আয়ের টাকা নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক অশান্তিসহ নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।
তথ্য অনুযায়ী, বিবাহবিচ্ছেদের প্রায় ৭৫ শতাংশ আবেদন স্ত্রীর পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক দেওয়ার হার ২৫ শতাংশ। আবেদন করার পর সমঝোতার মাধ্যমে সংসার টিকে যাওয়ার ঘটনা এক শতাংশ।
গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দুটি সালিশি আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়ে ৭ হাজার ৫৪৪টি। মামলাগুলোর মধ্যে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৩০৪টি মামলা। । হিসেবে এক শতাংশ সংসার টিকেছে। বাকিদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। যা গড়ে প্রতিদিন বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা প্রায় ২০টি।
এর আগে ২০২১ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ৭ হাজার ১০২ জন আবেদন করে।তারমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৪৭৮টি। আর ২০২২ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করা হয়েছে ৭ হাজার ৫৯০। তার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৫২০টি মামলা। ২০২১ সালে দৈনিক বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা ১৯ জন, ২০২২ সালে ২১ জন। তবে গত বছর ২০২৩ সালে এ সংখ্যা কিছুটা কম ছিল।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ৪১ ওয়ার্ডের ১৬টি থানা এলাকার বাসিন্দারা বিবাহবিচ্ছেদের এসব আবেদন করেন। এর মধ্যে এক শতাংশ ছাড়া বাকিদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।
বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিচ্ছেদের জন্য নারীদের আবেদনের প্রধান কারণ হলো- পরকীয়া, স্বামী মাদকাসক্ত, যৌতুক নিয়ে দ্বন্দ্ব, মতের অমিল, স্বামী-স্ত্রীর আয়ের টাকা নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক অশান্তিসহ নানা কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।
পাশাপাশি পুরুষদের আবেদনের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- পরকীয়া, মেয়ে সন্তান জন্মদানে অসন্তুষ্টি, ঠিকমতো সংসার না করা, স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির কথা না শোনা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানো।
বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সালিশি আদালতের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা দায়রা জজ) মনীষা মহাজনের সাথে।
তিনি চাটগাঁ নিউজকে বলেন, এখন যেসব কারণে সংসার ভাঙছে সেগুলো আগেও ছিল। তখন নারীরা নানা কারণে সবকিছু মুখ বোঝে সহ্য করতো। কিন্তু এখন নারীদের শিক্ষা, আর্থিক স্বাধীনতা যখন বাড়ছে তারা আর আগের মত সহ্য করছে না বা মানিয়ে নেয়ার পক্ষপাতি না। ফলে বিচ্ছেদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি যেমন একটি কারণ- আরেকটি কারণ হচ্ছে, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটছে, একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সম্পর্কে জড়াচ্ছে।
তিনি বলেন, সংসার ভাঙার জন্য দেনমোহর বড় ইস্যু বলে মনে করি না। পারস্পরিক আস্থাহীনতা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ও এর জন্য অনেকটা দায়ী। তাছাড়া পরিবারকে সময় না দেয়ার কারণেও পরস্পরের মধ্যে দুরত্ব বাড়ে। ফলে সংসারে জটিলতার সৃষ্টি হয়।
তিনি আরও বলেন, বিবাহবিচ্ছেদের যেসব আবেদন জমা পড়ে সেখান থেকে প্রত্যাহারের সংখ্যা খুবই কম। পারিবারিকভাবে সালিশ-বিচারের পর বিচ্ছেদের আবেদন করা হয়। তবে বেশিরভাগ আবেদন নারীদের পক্ষ থেকেই করা হয়।’
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়া, স্বাধীনচেতার নামে বেপরোয়া এবং স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সংসার ভাঙছে। মাদকাসক্তি, বিবাহ বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অভাব-অনটনের কারণেও বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।
চট্টগ্রামের মতো রক্ষণশীল সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সকলের ভূমিকা রাখতে হবে। কোন পরিবারে সমস্যা দেখা দিলে পারিবারিক কিংবা সামাজিকভাবে তা সমাধান করতে হবে। বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা কোনভাবেই কাম্য নয়।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ