চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া ২৬টি আসনের মধ্যে বেশিরভাগেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর চাপে ভরাডুবি হয়েছে জাতীয় পার্টির। এতে চরম অসন্তোষ নেতাকর্মীরা। এর রেশ না কাটতেই শুরু হয়েছে বহিষ্কারের খেলা। এরইমধ্যে কাজী ফিরোজ রশীদসহ দলটির একাধিক শীর্ষ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আরও অনেকে বহিষ্কার হতে পারেন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। ফলে উদ্বেগ আছে নেতাদের মধ্যে।
অন্যদিকে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করা প্রার্থীরা বিশেষ সভা ডেকে চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। দলের নেতাদের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আর বহিষ্কার ঘিরে দলে ভাঙনের আশঙ্কা করছেন অনেকে।
জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে দলটির ব্যাপক ভরাডুবি এবং বেহাল অবস্থার জন্যও প্রার্থীরা দলের শীর্ষ দুই নেতা জিএম কাদের ও চুন্নুকে দায়ী করেন। এছাড়াও নির্বাচনের সময় খরচের জন্য সরকারের তরফে ‘বিপুল পরিমাণ আর্থিক’ সহযোগিতা পাওয়ার তথ্য দিয়ে এই টাকার হিসাবও চাচ্ছেন নেতারা। নেতাদের এমন প্রকাশ্যে দাবি দাওয়া নিয়ে চাপ বাড়ছে জিএম কাদের ও চুন্নুর ওপর।
রোববার (১৪ জানুয়ারি) রাজধানীর কাকরাইল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিউট মিলনায়তনে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত বিশেষ সভায় জাপার পরাজিত প্রার্থীসহ বিক্ষুব্ধ নেতারা বক্তব্য দেন। সভায় নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৩০ জন বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেলেও সেখানে ১২২ জন প্রার্থী ছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে।
সভায় প্রার্থী ও দলের নেতারা অভিযোগ করেন, নির্বাচনের মাঠে হামলার মুখেও চেয়ারম্যান-মহাসচিবকে ফোনে পাননি তারা। এছাড়া নির্বাচনে তাদের আর্থিক সহযোগিতাও করা হয়নি। জিএম কাদের তার স্ত্রীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করার জন্য দলের একাধিক শীর্ষ নেতাকে কোরবানি দিয়েছেন। বিক্ষুব্ধ নেতারা নির্বাচনের জন্য বরাদ্দের টাকার হিসাব চাওয়ার দাবি তুলেছেন বিশেষ সভায়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের ক্ষোভ বৃদ্ধির নেপথ্যে সম্প্রতি কাজী ফিরোজ রশীদ, সুনীল শুভ রায়কে বহিষ্কার ও আরও কয়েকজনের বিষয়ে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আসার খবর আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, কাউন্সিলর ও জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টুসহ বেশ কয়েকজন পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। নেতাদের বিক্ষোভকে জিএম কাদের-চুন্নুকে দল থেকে সরানোর চেষ্টার অংশ হিসেবেও দেখছেন খোদ জাপা নেতাকর্মীরা।
এদিকে রোববারের সভার পর রাতে শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক এমপি ইয়াহয়া চৌধুরীকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দলের হাইকমান্ড থেকে বিশেষ সভায় অংশ না নেওয়ার চাপ থাকলেও তা গায়ে মাখেননি নেতারা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় শতাধিক প্রার্থী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উপস্থিত হন। এতে সভাপতিত্ব করেন দলের কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা -৪ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। এছাড়াও দলের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তারাও বক্তব্যে ক্ষোভ ঝেড়েছেন।
নেতাদের এত ক্ষোভ কেন?
বেশিরভাগ নেতার অভিযোগ জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, জিএম কাদের দলকে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেছেন। বড়বড় সভা-সমাবেশে যে নেতারা আর্থিক সহযোগিতা ও জনবল দিয়ে সফল করেন তাদের বলি দেওয়া হয়েছে স্ত্রী শেরিফা কাদেরের জন্য। সভায় জাপার শীর্ষ নেতাদের ভুল পথে নেওয়ার জন্য দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকেও দায়ী করেন অনেকে।
অবশ্য নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমি অনেক ছোট নেতা। দলে এত প্রভাব থাকলে আমি ধন্য হতাম। সবগুলো মিথ্যা বিষয়। নির্বাচন আমিও করেছি। নির্বাচনের সময় ঢাকায় আসার সুযোগ ছিল না। যারা অভিযোগ দিচ্ছে তারা প্রতিহিংসার কারণে হয়তো দিচ্ছে। আর আমাকে চেয়ারম্যান স্নেহ করেন। সেখান থেকে দূরে সরাতে এমনটা বলা হতে পারে।’
সিরাজগঞ্জ-১ আসনের প্রার্থী জহিরুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে গিয়ে আমার ওপর হামলা হলো, কর্মীদের ওপর আক্রমণ হলো। চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে অভিযোগ জানাতে ফোন দিলে তারা কল ধরেননি। আর্থিক সহযোগিতা না করলেও আমাদের তো অনন্ত সাহস দিতে পারতেন।
তিনি অভিযোগ করেন, আগেও দুই লাখ টাকার বিনিময়ে আলীগের প্রার্থীকে এনে লাঙল দেওয়া হয়। মনোনয়ন বাণিজ্য করলেন। দলকে এভাবে শেষ করে দেবেন না।
নোয়াখালী-৩ আসনের প্রার্থী ফজলে এলাহি সোহাগ বলেন, ‘আপনি (জিএম কাদের) তৃণমূলের সভায় আল্লাহর ভয় দেখিয়ে বললেন বেঈমান হব না। তৃণমূল যা চায় সে মোতাবেক আমি সিদ্ধান্ত নেব। অথচ সেদিন ৫৯ জনের মধ্যে ৫৭ জনই নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বললেন। আপনি কথা রাখেননি। আমরা জাতির সঙ্গে বেঈমানি করেছি। আমাদের নেতারা লোভী অথবা আপনি লোভী।
সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের প্রার্থী মোক্তার হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে দল থেকে বলা হলো নির্বাচন করো। তুমি কিছু খরচ করো, আর বাকিটা দল দেবে। সে মোতাবেক আমি দোকান বিক্রি করে প্রথম কয়েকদিন প্রচারণা চালিয়েছি। পরে জিএম কাদের ও চুন্নুকে কল দিলে তারা আর রিসিভ করেননি। ঢাকায় এসে দেখা করতে চাইলাম, তাও মানা করে দিয়েছে। কারণ, তাদের ভেতর ভয়, তারা যে টাকা আত্মসাৎ করেছে, কি জবাব দেবে?
মহাসচিবের সমালোচনা করে ফজলে এলাহি বলেন, ‘চুন্নু সাহেব কৌশলের কথা বলেছেন। কিসের কৌশল? পুরো দলকে ধ্বংস করার কৌশল? প্রার্থীদের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার কৌশল? আপনি (জিএম কাদের) চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ছিলেন এক, চেয়ারম্যান হওয়ার পর হয়েছেন আরেক। অনেক পরিবর্তন আপনার। প্রেসিডিয়াম সদস্য কেরানির মতো ফাইল নিয়ে আপনার পেছনে ঘুরেন। তিনি দলের প্রেসিডিয়াম কি করে হয়।’
জিএম কাদেরকে উদ্দেশ্য করে সাবেক এমপি ও সিলেটের প্রার্থী ইয়াহইয়া চৌধুরী বলেন, ‘আপনি গণতন্ত্র শিখিয়েছেন অথচ আপনার মধ্যে গণতন্ত্র নেই। আপনার স্ত্রীর জন্য ফিরোজ, বাবলা, খোকা, পীর ফজলু, আতিকসহ নয়টি সিট কোরবানি দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘সমাঝোতার আসনের জন্য চেয়ারম্যান নিজের স্ত্রী, নাতি আর মেয়ের ভাসুরের জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছেন। আপনার স্ত্রী শুধু আপনাকে রান্না করে ভাত খাওয়ান, দলে তার কী অবদান বলেন। আমাদের টাকা আপনারা ভাগ বাটোয়ারা করেছেন। আপনাদের জবাব দিতে হবে ‘
প্রার্থী ও নেতাদের এমন ক্ষোভের বিষয়ে জাপা চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, যারা নির্বাচন করেছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এটা ঠিক। বলা হয়েছিল দলের ফান্ডের ব্যবস্থা করা গেলে টাকা দেওয়া হবে। সেটা করা যায়নি তাই এই ক্ষোভ। কিন্তু যারা বৈঠক করেছে তারা বেশিরভাগ প্রার্থী না। আর এটা কাজী ফিরোজ রশীদ, কাজী মামুনদের বাসায় চেয়ারম্যান-মহাসচিবকে বাদ দেওয়ার জন্য মিটিং হয়েছিল। এটা সেটার ফলোআপ মিটিং।’
চাটগাঁ নিউজ/এসএ