অর্ধ শতাধিক মামলার মারপ্যাঁচে তারেক, সাজা ৬টিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যিনি ফেরারি হয়ে দেশের বাইরে বসবাস করছেন। অর্ধ শতাধিক মামলার মারপ্যাঁচে পড়ে পরিবর্তীত সময়ে এসেও দেশে ফিরতে পারছেন না তিনি। কারণ ৬টি মামলায় তিনি সাজাভুক্ত আসামি। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব মামলা হয়। যেখানে তারেক রহমান একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

জানা গেছে, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৭টি মামলা হয়। পরবর্তী সময় শেখ হাসিনার সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ২১শে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, অর্থ-পাচার এবং দেশব্যাপী মানহানির মামলাসহ আরো অন্তত ২০টির মতো মামলা হয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশ কয়েকটি মামলা তুলে নিচ্ছে বাদীপক্ষ এমনটিও শোনা যাচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমান দেশে ফিরে নির্ঝঞ্ঝাট রাজনীতি করতে চাইলে সবগুলো মামলা থেকে তাকে বেকসুর খালাস পেতে হবে। নাহয় এই মুহূর্তে দেশে ফেরাটা কঠিন হয়ে যাবে।

বিএনপির তথ্য ও সংরক্ষণ শাখা সূত্রে জানা গেছে, দলটির কেন্দ্রীয় ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় লাখ মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যাও ৪০ লাখের ওপরে। বিএনপির চেয়ারপারসন ও মহাসচিব থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই মামলার আসামি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে আছে ৯৮টি মামলা। মামলার দিক থেকে সবার উপরে আছেন যুগ্ম মহাসচিব হাবীব-উন-নবী খান সোহেল, মামলার সংখ্যা প্রায় ৪৫০টি।

তারেক রহমানের যত মামলা

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা : তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আলোচিত মামলা হচ্ছে ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলা মামলা। ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। সেই হামলায় তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও নিহত হন ২৪ জন। আহত হন চার শতাধিক নেতাকর্মী।

ঘটনার পর থেকেই এই হামলার জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের দায়ী করে আওয়ামী লীগ। ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানোর মাধ্যমে তৎকালীন সরকার এই ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করায় আওয়ামী লীগের এই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়।

২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর হামলার ঘটনার পুনঃতদন্ত শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় অধিকতর তদন্ত। এই তদন্ত শেষে তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

এ মামলায় মুফতি হান্নানসহ মোট ১৮ জন আসামি স্বীকারোক্তি দেয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এ মামলায় রায় দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। ৫২ জন আসামির মধ্যে তিনজনের অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় বাকি ৪৯ জনের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এছাড়া তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এই মামলার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, আগের বেঞ্চ থাকলে সেখানে শুনানি হবে। আর যদি ওই বেঞ্চের জুরিসডিকশন না থাকে তাহলে নতুন বেঞ্চে শুনানি হবে। এ ক্ষেত্রে আবারও শুরু থেকে শুনানি হতে পারে।

অবশ্য শুরু থেকেই এ মামলার পুনঃতদন্ত ও অধিকতর তদন্ত নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে আইনজীবী প্যানেলের প্রত্যেকটি সদস্য জোরের সঙ্গে বলে আসছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তারেক রহমানের ন্যুনতম সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তারেক রহমানাকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। মুফতি হান্নানের কাছ থেকে জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে।

বিএনপির আইন সম্পাদক কায়সার কামাল এই বিষয়ে বলেন, এ মামলায় মোট পাঁচটা চার্জশিট হয়েছিল। এরমধ্যে ওয়ান ইলেভেনের সময় দেওয়া চতুর্থ চার্জশিটেও তারেক রহমানের নাম ছিল না। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চম চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম ঢোকানো হয় এবং ফরমায়েশি রায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায়:  একই দিনে ওই ঘটনা থেকে উদ্ভূত বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায়ও রায় দেওয়া হয়। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় তারেক রহমানকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা : ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা দুই কোটি ১০ লাখ টাকা ট্রাস্টের কাজে ব্যবহার না করে নিজেদের হিসাবে জমা রাখার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে এমন অভিযোগে এই মামলাটি দায়ের করা হয়।

দীর্ঘ ১০ বছর মামলার কার্যক্রম চলার পর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার রায় হয়। রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। একইসঙ্গে তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হাইকোর্ট পরে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড বাড়িয়ে ১০ বছর করেন।

প্রায় ২৫ মাস কারাভোগের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে। দেশের বাইরে থাকায় এবং সাজা ভোগ না করায় তারেক রহমানের সাজা এখনও বহাল আছে। মামলাটি বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলাটিও দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে কাজ করছের বিএনপির আইনজীবীরা।

জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের মামলা : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আরও একটি মামলায় তারেক রহমানের নাম উঠে আসে। ২০০৭ সালে তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ও জোবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবাল বানুর বিরুদ্ধে এ মামলা করে দুদক। মামলায় আর্জিতে বলা হয়, তারেক রহমান ও তার স্ত্রীর ঘোষিত আয়ের বাইরেও চার কোটি ৮০ লাখ টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থের অবৈধ সম্পদ রয়েছে। গত বছরের ২ আগষ্ট এ মামলায় তারেক রহমানকে ৯ বছরের এবং তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।

পরে গত ২৯ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ আবু সাঈদ মোল্লার সই করা এক প্রজ্ঞাপনে ডা. জোবাইদা রহমানের সাজা এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ডা. জোবাইদা রহমানের সাজা স্থগিতের বিষয়ে দাখিল করা আবেদন এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের মতামতের আলোকে ফৌজদারি কার্যবিধির কোড, (আইন নং-ভি ১৮৯৮ সাল) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আদালতে আত্মসমর্পণ করে আপিল দায়েরের শর্তে এক বছরের জন্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সাজা স্থগিত করা হল। মামলাটিতে তারেক রহমানের ৯ বছরের সাজা এখনও বহাল আছে। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ মামলাটি ফায়সালার চেষ্টা করছেন তার আইনজীবীরা।

অর্থপাচার মামলা : সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের একটি মামলায় ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকার একটি আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেন। ওই মামলায় তারেকের বন্ধু ও ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে দুদক। ২০১৬ সালে বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেন। এ মামলার চূড়ান্ত ফায়সালার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত যেতে হবে তারেক রহমানকে।

মানহানির মামলা : লন্ডনের এক সমাবেশে ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজাকার ও পাকবন্ধু বলে কটূক্তি করেন তারেক রহমান।  এসব অভিযোগ এনে সে সময় নড়াইলে তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বিশ্বাস। ওই মামলায় ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয় নড়াইলের আদালত। ঢাকার আদালতেও মানহানির অভিযোগে কমপক্ষে ১০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি ও ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে এসব মামলা দায়ের হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা : তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের একাধিক মামলাও রয়েছে। একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আবদুস সালামের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টির অভিযোগ এনে ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি তেজগাঁও থানায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলা করা হয়। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি আছে। এছাড়াও নোয়াখালীতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আরেকটি মামলা রয়েছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। ওই মামলায়ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা : ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাও রয়েছে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির অভিযোগে ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী।

দলীয় সূত্র বলছে, কোনো অনুকম্পা বা নির্বাহী আদেশ নয়, আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাগুলো মোকাবিলা করতে চান তারেক রহমান। এ জন্য তার পক্ষে শক্তিশালী একটি আইনজীবী প্যানেল কাজ করছে। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মামলাগুলো ফায়সালা করেই দেশে ফিরবেন তিনি এমনটি শোনা যাচ্ছে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দীন খোকন বলেন, তারুণ্যের আইডল তারেক রহমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই আইনি প্রক্রিয়াতেই মামলাগুলো মোকাবিলা করবেন। তার আইনজীবী হিসেবে মামলাগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি ন্যায় বিচার পেলে সবগুলো মামলায় উনি বেকসুর খালাস পাবেন।

ওয়ান ইলেভেনের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ব্যবসায়ীদের আটক করে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই বছরের ৭ মার্চ গ্রেফতার করা হয় তারেক রহমানকে। পরের বছর ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেয়ে লন্ডন চলে যান তিনি।

চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ/এসএ

Scroll to Top