ফরহাদ সিকদার ও মোঃ শোয়াইব: দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক রুইজাতীয় মাছের প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী পড়েছে নতুন এক ভয়াবহ সংকটে। নদী দূষণ, অবৈধ বালু উত্তোলন ও নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে মা মাছ শিকারের পাশাপাশি এবার যুক্ত হয়েছে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা। যা নদীর পুরো জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।
গত ছয় মাসে হাটহাজারী ও রাউজানের বিভিন্ন অংশ থেকে মোট ৭টি মা মাছ (ব্রুড ফিশ) মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মাছগুলোর মধ্যে ২ থেকে ২০ কেজি ওজনের কাতলা, মৃগেল ও আইড় রয়েছে। প্রাথমিক সুরতহালে কিছু মাছের শরীরে ধারালো বস্তু ও বরশির আঘাত দেখা গেলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মোঃ মনজুরুল কিবরিয়ার গবেষণায় উঠে আসে আরও ভয়াবহ তথ্য – মৃত মাছের শরীরে পাওয়া গেছে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি।
‘নাইট্রো’ কীটনাশকই বড় হুমকি
মুলত হালদায় মাছ ধরার কাজে – স্থানীয় দোকানগুলোতে সহজেই পাওয়া ক্লোরপাইরিফস ও সাইপারমেথ্রিনের সংমিশ্রণে তৈরি নাইট্রো নামক একধরনের কীটনাশক ব্যবহার করছে অসাধু মাছ শিকারিরা। সরেজমিনে কৃষক ও স্থানীয় মৎস্য শিকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে – ধান বা সবজিক্ষেতে পোকামাকড় মারার জন্য বহুল ব্যবহৃত এই বিষটি আগে থেকেই চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া বড় বড় মাছের ঘের বা প্রজেক্টে মাছ তুলে নেওয়ার পর কীট ধ্বংস করতেও ব্যবহৃত হয় এই রাসায়নিক।
তবে সম্প্রতি জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী স্থির পানির সময়টাতে এই একই কীটনাশক এখন হালদা নদীতেও প্রয়োগ করছে অনেক অসাধু জেলে। ফলে চিংড়ি মাছ থেকে শুরু করে বড় মাছ পর্যন্ত কয়েক মিনিটের মধ্যেই পানির ওপর ভেসে ওঠে এবং খুব সহজেই ধরা যায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও হালদা নদী গবেষক ড. মোঃ মনজুরুল কিবরিয়া বলেন – “এই রাসায়নিকটি পানিতে দেওয়ার সাথে সাথেই একটি নির্দিষ্ট জায়গা অক্সিজেনশূন্য হয়ে যায়। ফলে সেখানে চিংড়ি, পোকামাকড় কিংবা যেকোনো মাছের বেঁচে থাকার আর কোনো সুযোগ থাকে না।”
তিনি আরও সতর্ক করে বলেন – “এভাবে যদি নিয়মিত হালদার বিভিন্ন জায়গায় বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরা হয়, তাহলে কোনো একসময় হালদার পানি পুরোপুরি অক্সিজেনশূন্য হয়ে যাবে-যেখানে কোনো মাছই আর বেঁচে থাকতে পারবে না।”

শাখা খালেই বেশি বিষ প্রয়োগ: ফার্মেসি ও মুদির দোকানে অবাধে বিক্রি হচ্ছে নাইট্রো কীটনাশক
হালদা নদীর সাথে যুক্ত রয়েছে ১৭টি শাখা খাল – যার মধ্যে ধুরং খাল, সর্তা খাল, কাগতিয়া খাল, সোনাই খাল, মাদারী খালসহ আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব খালেই চলছে বিষ প্রয়োগ করে অবৈধ মাছ শিকার। এছাড়া ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে হালদাজুড়ে বেড়েছে অবৈধ বালু উত্তোলণ, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইঞ্জিনচালিত নৌকার অবাধ চলাচল ও নানাভাবে করা হচ্ছে হালদার নদী ও পরিবেশ দুষণ।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শেখ আহমাদ আল নাহিদ বলেন, “সুন্দরবনের বিভিন্ন খালে কীটনাশক দিয়ে মাছ মারার ঘটনা আমরা দেখেছি। সেই একই ধরনের বিষ এবার প্রয়োগ হচ্ছে হালদা নদীতেও। অথচ মৎস্য অধিদপ্তর বা ফিশারিজে এটার কোনো অনুমোদন নেই।”
ড. নাহিদ আরও বলেন, “হালদা নদীতে যেসব শাখা খাল রয়েছে, মূলত সেসব খালেই গভীর রাতে অনেক অসাধু জেলে সহজ উপায়ে মাছ ধরার জন্য মাত্রাতিরিক্তভাবে এই কীটনাশকটি ব্যবহার করছে। আর এই শাখা খালগুলো থেকেই বিষটি মূল হালদায় এসে পড়ছে। অথচ এই রাসায়নিকের ন্যূনতম ব্যবহারেরও কোনো সুযোগ নেই।”

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় – হাটহাজারী ও রাউজানের সাধারণ ফার্মেসি থেকে শুরু করে মুদির দোকানেও নির্বিঘ্নে বিক্রি হচ্ছে এই ক্ষতিকর কীটনাশক। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় – হালদায় মাছ নিধন রোধে উপজেলা প্রশাসন যে পাহারাদার নিয়োগ দিয়েছে, তাদের অনেকের সাথে অসাধু জেলেদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে প্রশাসনের অভিযান পরিচালনার আগেই খবর ফাঁস হয়ে যায়, আর অনেক সময় অভিযুক্তরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
যদিও বিষ প্রয়োগকারীদের শনাক্ত করে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা করেছে প্রশাসন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শওকত চাটগাঁনিউজকে বলেন – “উপজেলা প্রশাসন এবং মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ঘোষণা করেছি – যারা বিষ দিয়ে মাছ ধরে তাদের ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে। আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে, কিন্তু সমস্যা হলো – এরা খুবই ধুর্ত। ১০-২০ মিনিটের মধ্যেই কাজ সেরে ফেলে। তবে পাহারাদার, গ্রামপুলিশসহ আমরা সবাই তৎপর আছি।”
এ ছাড়া নিয়মিত অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি সচেতনতা গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন। তিনি বলেন – “ইতিমধ্যে সেইসব এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বেশ কিছু জাল জব্দ করেছি এবং জরিমানা করেছি। হালদায় বিষ প্রয়োগে কিংবা জাল দিয়ে কোনোভাবেই মাছ ধরা যাবে না। আমরা তৎপর আছি এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

হালদার ইকোসিস্টেমে ভয়াবহ প্রভাব, খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ার শঙ্কা!
হালদার জীববৈচিত্র্যের ওপর বিষ প্রয়োগে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে জানতে চাইলে ড. শেখ আহমাদ আল নাহিদ বলেন – “হয়তো বড় মাছগুলো মারা যাচ্ছে যা আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু ছোট যে কীটপতঙ্গগুলো মারা যাচ্ছে, আমরা তা দেখতে পাই না। প্রাকৃতিক পরিবেশে মাছ সাধারণত ফাইটোপ্ল্যাংকটন (উদ্ভিদকণা) এবং জুপ্লাংকটন (প্রাণীকণা) খেয়ে বাঁচে। এই বিষ প্রয়োগের ফলে এগুলোই সবার আগে মারা যাচ্ছে। অর্থাৎ বড় মাছগুলো যে খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকে – সেই মূল খাবারই ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরও যোগ করেন – “ফুড চেইন বা খাদ্যশৃঙ্খলের কোনো একটি জায়গায় আঘাত করলে পুরো শৃঙ্খলাই ভেঙে পড়ে। অর্থাৎ বিষ প্রয়োগের কারণে হালদার পুরো ইকোসিস্টেমই এখন ক্ষতির মুখে।”
সম্প্রতি দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক রুইজাতীয় মাছের প্রজননক্ষেত্র এই হালদা নদীকে ‘মৎস্য হেরিটেজ এলাকা’ ঘোষণা করেছে সরকার। গেলো ৫ নভেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত সরকারি গেজেট প্রকাশ করেছে। নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণের লক্ষ্যে যেখানে আরোপ করা হয়েছে ১৭টি কঠোর নিষেধাজ্ঞা। যেগুলো হলো,
(১) নদী থেকে কোনো প্রকার মাছ বা জলজ প্রাণী ধরা বা শিকার করা যাবে না।
(২) মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট সময়েই কেবল নিষিক্ত ডিম আহরণ করা যাবে।
(৩) প্রাণি ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
(৪) নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যাবে না।
(৫) মাছ, ডলফিন বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কাজ করা নিষিদ্ধ।
(৬) বসতবাড়ি বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের পয়ঃবর্জ্য নদীতে ফেলা যাবে না।
(৭) নদীর বাঁক কেটে সোজা করা যাবে না।
(৮) ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৭টি সংযুক্ত খালে মাছ ধরা নিষিদ্ধ।
(৯) নতুন রাবার ড্যাম বা কংক্রিট ড্যাম নির্মাণ করা যাবে না।
(১০) তদারকি কমিটির অনুমতি ছাড়া পানি শোধনাগার বা সেচ প্রকল্প থেকে পানি উত্তোলন করা যাবে না।
(১১️) দেশি বা বিদেশি কেউ অনুমতি ছাড়া গবেষণা পরিচালনা করতে পারবে না।
(১২️) নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
(১৩️) কর্ণফুলী মোহনা থেকে নাজিরহাট ব্রিজ পর্যন্ত ভারী ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ।
(১৪️) হালদা ও এর শাখা নদীতে বালুমহাল ইজারা দেওয়া যাবে না এবং ড্রেজার ব্যবহার বন্ধ থাকবে।
(১৫️) নদীর অববাহিকায় তামাক চাষ নিষিদ্ধ।
(১৬️) কৃষিজমিতে ক্ষতিকর কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে না।
(১৭️) নদীর পাড়সংলগ্ন এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।
গেজেটে আরও বলা হয়েছে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন বা পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটলে এলাকাভিত্তিক সীমারেখা ও বিধিনিষেধ সময়মতো হালনাগাদ করা হবে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মন্জুরুল কিবরিয়া বলেন – “হালদা রক্ষায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে হবে নদীর পাড়ের মানুষদের। বাইরে থেকে কেউ এসে এখানে বিষ দিয়ে বা জাল ফেলে মাছ ধরে না -তারাই বিষ মারে, তারাই মাছ ধরে। আবার পাহারাদাররাও নদীর পাড়ের মানুষ; এ নদীর সুফলভোগীও তারা সকলেই। এখন তারা নিজেরাই যদি নদী রক্ষায় এগিয়ে না আসে, বরং এসব আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে – তাহলে হালদাকে রক্ষা করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।”
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শেখ আহমাদ আল নাহিদ বলেন – “হালদা নদী রক্ষা করতে হলে প্রথমেই হালদা পাড়ের মানুষদের সচেতন করতে হবে। স্কুলভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করতে হবে – প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে হাইস্কুল পর্যন্ত নিয়মিত সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাতে হবে। এলাকায় এলাকায় উঠান বৈঠক করতে হবে। পুরুষদের পাশাপাশি পরিবারের নারীদেরও সচেতন করতে হবে। না হলে হালদা নদী কেবল নামেই থাকবে – তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলবে।”
শুধু তাই নয় – হালদা নদী রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি অধিদপ্তর ও আইন শৃংখলা বাহিনী একসাথে যৌথভাবে কাজ করা উচিত বলে মনে করছেন এই দুই গবেষক। পাশাপাশি হালদা নদীর পাড়ঘেঁষে থাকা কৃষিজমিতে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের প্রতিও জোর দেন তাঁরা। বিশেষ করে নাইট্রো নামক এই ক্ষতিকর বিষ যেনো বাজারে সহজলভ্য না হয় সে ব্যাপারেও নজরদারি বাড়ানোর দাবী তাঁদের।






