চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ বা টানেল দিয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম চলাচল করেছে।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। যে কারণে প্রতিদিন প্রচুর লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই গাড়ির সংখ্যা বাড়ানোর মাধ্যমে আয় বাড়াতে নানা পরিকল্পনা আঁটছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণে জোর দিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের উপকূলে এই রাস্তা নির্মাণে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে চিঠি দিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
গত সেপ্টেম্বরে এই চিঠি দেওয়া হয়। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, মেরিন ড্রাইভ নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার (ফিজিবিলিটি স্টাডি) কাজ শেষ হয়েছে। ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণে ৩০–৩৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে। তবে অর্থায়নের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হয়নি।
এদিকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গাড়ি চলাচলের পরিমাণ বাড়াতে টানেল সংযোগ সড়কের সঙ্গে লাগোয়া একটি রাস্তা সম্প্রসারণে ৪৬৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।
কর্ণফুলী টানেল চালুর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে গত মঙ্গলবার। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। পরদিন থেকে গাড়ি চলাচল শুরু হয়।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ব্যয় হয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। চীনা ঋণ এবং বাংলাদেশ সরকারের তহবিলের টাকায় এই টানেল নির্মাণ করে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। এখন টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও পেয়েছে তারা।
লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছেও নেই
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হয় ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর। শুরুর পর থেকে এ বছর ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত গাড়ি চলেছে ২৮ লাখ ২১ হাজার ৩৭৬টি। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে গাড়ি পার হয়েছে ৩ হাজার ৮৭০টি। এই সময়ে আয় হয়েছে ৮০ কোটি ৫ লাখ টাকা। প্রতিদিন গড়ে আয় ১০ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
সড়ক যোগাযোগের যেকোনো অবকাঠামো তৈরির সময় যানবাহন চলাচলের একটি প্রক্ষেপণ করা হয়। টানেলের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০২৫ সালে দিনে গাড়ি চলাচল করার কথা ১৯ হাজার ৬৬৯টি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দিনে কম চলছে ১৫ হাজার ৭৯৯টি গাড়ি।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদাউস বলেন, সেতু কর্তৃপক্ষ টানেল ও এর সংযোগ সড়ক নির্মাণ করেছে। আনোয়ারা থেকে গাছবাড়িয়া পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত করতে সওজের একটি প্রকল্প এখন অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের উপকূলে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করবে সওজ। এ জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে আনোয়ারা প্রান্তে নগর উন্নয়নের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। এসব হয়ে গেলে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচলের পরিমাণ বাড়বে।
টানেলে গাড়ির পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সড়ক সম্প্রসারণ ও মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এসব বিষয়ে তাঁর কাছে এখনো প্রস্তাব আসেনি।
সড়ক প্রশস্তে ৪৬৬ কোটি টাকার প্রকল্প
টানেল ব্যবহারকারী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের গাড়িগুলো আনোয়ারা, শিকলবাহার ওয়াই ক্রসিং হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ব্যবহার করে। কক্সবাজার পর্যন্ত এই পথের দৈর্ঘ্য ১৪১ কিলোমিটার। তবে আনোয়ারার কালাবিবির দিঘির মোড় থেকে চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কটি চার লেনে উন্নীত করা হলে এই দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার কমে ১২৮ কিলোমিটারে নেমে আসবে। কক্সবাজারে যেতে সময় বাঁচবে অন্তত আধা ঘণ্টা।
সওজের চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগ ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি সম্প্রসারণে ২০২৩ সালে ৪৬৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে। বর্তমানে সড়কটি সাড়ে ৫ মিটার প্রশস্ত, নতুন করে করা হবে সাড়ে ১০ মিটার।
সওজের প্রকল্পসংক্রান্ত নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, এই সড়ক সম্প্রসারণ করা হলে কর্ণফুলী টানেল দিয়ে কক্সবাজারমুখী গাড়ি চলাচলের একটি বিকল্প সড়ক তৈরি হবে। টানেল দিয়ে আসা গাড়িগুলো শিকলবাহা ক্রসিং-বিজিসি ট্রাস্ট-গাছবাড়িয়া পর্যন্ত বিদ্যমান সড়ক ব্যবহার না করে এই সড়ক ব্যবহার করতে পারবে। ফলে টানেলে গাড়ি চলাচলের পরিমাণ বাড়বে। শাহ আমানত সেতুতে গাড়ির চাপ কমবে।
সওজের চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, আনোয়ারা থেকে চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া পর্যন্ত সড়ক সম্প্রসারণের প্রকল্প নেওয়া হলেও তা এখন পর্যন্ত অনুমোদন হয়নি। পরিকল্পনা কমিশন থেকে ডিপিপির বিষয়ে কিছু সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। সংশোধনের পর তা আবার কমিশনে পাঠানো হবে।
মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের প্রস্তাব
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা গত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় কর্ণফুলী টানেলের পূর্ণ ব্যবহারের লক্ষ্যে ‘চট্টগ্রামের মিরসরাই শিল্পনগর থেকে আনোয়ারা-বাঁশখালী হয়ে পেকুয়া-মাতারবাড়ী কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ’ নির্মাণে গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে কর্ণফুলী টানেলের বেশির ভাগ গাড়ি চট্টগ্রাম শহরমুখী। মেরিন ড্রাইভ নির্মিত হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী যানবাহন সরাসরি আনোয়ারা হয়ে বিকল্প এই সড়ক ব্যবহার করতে পারবে। এতে চট্টগ্রাম নগরের ভেতরে যানজট অনেকটা কমে আসবে। এ ছাড়া এই রুট ব্যবহারের ফলে সামগ্রিকভাবে যাতায়াতের সময় ও খরচ কমে আসবে।
সওজের চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহেদ হোসেন বলেন, চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার (ফিজিবিলিটি স্টাডি) কাজ শেষ হয়েছে। ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণে প্রায় ৩০–৩৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণে প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য দাতা সংস্থা নির্ধারণ করবে ইআরডি। তবে এখন পর্যন্ত কে অর্থায়ন করবে, তা নিশ্চিত হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলামের মতে, টানেলের পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য মিরসরাই শিল্পনগর থেকে আনোয়ারা-বাঁশখালী হয়ে পেকুয়া মাতারবাড়ী কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করতে হবে। ভবিষ্যতে এই এলাকা শিল্পায়ন, পর্যটন ও আবাসন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে। আর কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর চালু হলে এবং মিরসরাই শিল্প অঞ্চল চালু হলে টানেলের ব্যবহার আরও বাড়বে।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ







