বান্দরবান প্রতিনিধি: বান্দরবানের জন্য রাজার সনদ যেন একটি সোনার হরিণ। এটি ছাড়া না পাবে সরকারি চাকরি না পারবে জায়গা রেজিষ্ট্রি করতে। এই সনদের অফিসিয়াল মূল্য হচ্ছে মাত্র ২০০ টাকা। অথচ অসংখ্য মানুষের অভিযোগ এই সনদের জন্য বর্তমানে নেওয়া হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাও আবার দালাল ছাড়া পাওয়া যায়না। সরাসরি যদি কেউ আবেদন করতে যায় কাগজপত্রে বিভিন্ন ভুলের দোহায় দিয়ে তাদের কাছ থেকে আবেদনও জমা নেওয়া হয় না, পরে দালালের মাধ্যমে গেলে কাগজপত্র ছাড়া শুধু এনআইডি কার্ড দিয়ে ঠিকই রাজার সনদ দেওয়া হয়।
এদিকে এই সনদ অনেক রোহিঙ্গাদের হাতেও চলে গেছে এবং তারা এই সনদ নিয়ে জায়গা কিনে রেজিষ্ট্রি করার অসংখ্য অভিযোগও রয়েছে।
বান্দরবান জেলায় ভূমি রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে বা কোন সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে গেলে স্থায়ী বাসিন্দার প্রমাণ হিসেবে এই রাজার সনদের প্রয়োজন পড়ে। কারণ পার্বত্য এলাকায় এটি ছাড়া কোন ক্রেতা বা বিক্রেতা জায়গা ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না, এমনকি কোন ব্যক্তি পার্বত্য এলাকায় চাকরির আবেদনও করতে পারবে না। তাই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বেশ কিছু চিহ্নিত দালাল বোমাং রাজার অফিসের কর্মচারীদের সাথে আঁতাত করে এই রাজার সনদের অবৈধ বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। একটি রাজার সনদের দাম নিচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বিষয়টি নিয়ে বান্দরবানবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিমাসে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টার মতো অবৈধভাবে রাজার সনদ বিক্রি করা হচ্ছে। চড়া দামে এই সনদ অবৈধভাবে ক্রয় করে প্রায় কয়েকশ ব্যক্তি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি করার অভিযোগও রয়েছে। আরও স্পর্শকাতর বিষয় হচ্ছে এই সনদ এখন রোহিঙ্গারাও টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে জায়গা কিনে রেজিষ্ট্রি করছে।
এরকমই একজন রোহিঙ্গা হামিদ হোসেন, যিনি সম্প্রতি মায়ানমার থেকে এসে বান্দরবানের লামা উপজেলার আজিজনগর ইউনিয়নে মোটা অংকের টাকা বিনিময়ে রাজার সনদ নিয়ে প্রায় ৫ একর মতো জায়গা কিনেছে। করেছে কোটি টাকা খরচ করে রাজকীয় বাড়ি এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসও করছে। একই ঠিকানা ব্যবহার করে সে করেছে এনআইডি কার্ড, জন্মনিবন্ধন এমনকি পাসপোর্টও। এ ব্যাপারে হামিদ হোসেনের বক্তব্যের জন্য মোবাইলে কল দিলে তিনি কল রিসিভ করেননি এবং জানা যায় তিনি বর্তমানে সৌদি আরব অবস্থান করছেন।
একইভাবে রাজার সনদ কিনে আলীকদমের চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের জয়নাল মেম্বার পাড়ার বাসিন্দা আবুল বশরকে বাবা সাজিয়ে মো. লালু নামের আরেক রোহিঙ্গা জায়গা কিনে ঘর করারও অভিযোগ উঠেছে। মো. লালু আলীকদম উপজেলা সদরের দানুসর্দার পাড়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। লালুর নামে আবুল বশর বাদি হয়ে আলীকদম ইউএনও অফিসে একটি অভিযোগও দায়ের করেছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাদী আবুল বশর নিজেই।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আসমাউল হুসনা, যার বাড়ি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায়। তিনি এ প্রতিবেদককে অভিযোগ করে বলেন, আমি আলীকদমে উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেছি। ২০২৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় পার্বত্য কোটা সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে এই সনদ সংগ্রহ করি। কিন্তু আমাকেও ১৬,০০০ টাকা প্রদান করতে হয়েছে, যা আমার জন্য এডমিশন টাইমে বড় ধরনের আর্থিক চাপ ও মানসিক হয়রানির কারণ ছিল।
তিনি আরও বলেন, একই ভৌগোলিক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেও বাঙালি ও উপজাতি নাগরিকদের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য থেকে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো—কেন একই এলাকায় জন্ম নেওয়া দুই সন্তানের জন্য ভিন্ন মানদণ্ড থাকবে?
এদিকে এমন অনেক স্থানীয়রা আছে যাদের সব কাগজপত্র থাকার পরও রাজার সনদ পাচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করা শর্তে লামা, আলীকদম ও নাইক্ষংছড়ি উপজেলার বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আমাদের বাবার নামে জায়গার কাগজ এবং অন্যান্য সকল কাগজপত্র আছে। আমাদের নামে নামজারি না হওয়ায় রাজার সনদে আমার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।
এই রাজার সনদ ক্রয়-বিক্রয় হয়ে আসছে অফিসের কিছু অসাধু কর্মচারী ও কিছু দালালের মাধ্যমে। পরিচয় গোপন করে কথা হয় ফজলু নামের একজন দালালের সাথে। তার বাড়ি লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে। তার কাছে ক্লায়েন্ট সেজে কথা বলার এক পর্যায়ে কত টাকা লাগবে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি মুখের ওপর একদাম ৩০ হাজার টাকা লাগবে বলে সাফ জানিয়ে দেন এবং শুধু ১ কপি এনআইডি কার্ডের ফটোকপি ছাড়া কোন কাগজপত্র লাগবে না। সনদ পেতে সময় লাগবে ১৫ দিন। অথচ বোমাং রাজার অফিসে গেলে এই কাগজ সেই কাগজ, মোট কথা কাগজ লাগার কোন শেষ নাই বললেই চলে। তাছাড়াও টাকা ছাড়া কখন এই সনদ হাতে পাবে বা আদৌ পাবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নাই। স্থানীয়রা জানায়, এরকম আরো অনেক দালাল রাজার অফিসের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করছে।
লামা উপজেলার খালেদা আক্তার নামের একজন মহিলা দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। তিনি বলেন, অনেক কষ্টে, ধারকর্জ করে ১ লক্ষ বিশ হাজার টাকায় তিন গন্ডা জায়গা কিনেছিলাম ২০১৭ সালে। টাকার অভাবে জায়গা রেজিষ্ট্রি করতে পারছি না। তার ওপর গলার কাঁটা হিসেবে রয়েছে রাজার সনদ। এই সনদ কিনতে নাকি ৩০ হাজার টাকা লাগবে। এই টাকা আমি পাব কোথায়?
এ ব্যাপার বান্দরবান বোমাং রাজার সাথে মুঠোফোনে অসংখ্যবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে এভাবে রাজার সনদ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন বোমাং রাজা অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অংজাই খাইং। তিনি বলেন, এরকম সনদ আমরা দিইনি। এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। রাজার সাথে কথা বলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মো মজিবুর রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সমস্যা নিরসনে আমরা সরকারের কাছে ১৯ দফা দাবি রেখেছি। তার মধ্যে ৯ নং দফা হচ্ছে রাজার সনদ বাতিল করা। কারণ এটি নিয়েই বান্দরবানের মানুষের এখন খুব বেশি ভুগতে হচ্ছে। সুতরাং রাজার সনদ প্রথা বাতিল করা উচিত।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, আমাদের কাছে কেউ স্পেসিফিক অভিযোগ করেনি এখনো। যদি কেউ অভিযোগ করে বা আপনারা নিউজ করেন তাহলে তার ভিত্তিতে আমরা হয়তো তদন্তে নামতে পারবো।
চাটগাঁ নিউজ/ইলিয়াস/এমকেএন