সবুজের ছায়ায় ফিরছে বন্যপ্রাণী, নতুন করে জেগে উঠছে উখিয়ার বন

উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি: কয়েক বছর আগেও কক্সবাজারের উখিয়ার বনাঞ্চলে শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন—কাটা গাছ, ভাঙা পাহাড় আর উজাড় পরিবেশ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঠাঁই দিতে গিয়ে ২০১৭ সালে উখিয়ার থাইংখালী, পালংখালী, বালুখালী ও কুতুপালংসহ বিভিন্ন এলাকায় সংরক্ষিত বনভূমি দখল করে তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ী আশ্রয়শিবির।

রোহিঙ্গাদের বসতি ও রান্নার জ্বালানির জন্য নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হয়, যার ফলে কয়েক হাজার একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ও সরকারি নানা উদ্যোগে আবারও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে সেই উজাড় হওয়া বনাঞ্চল।

বন বিভাগের তথ্যমতে, রোহিঙ্গা আগমনের ফলে প্রায় ৮,০০০ একরের বেশি বনভূমি ধ্বংস হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে বিভিন্ন ধাপে উখিয়ার থাইংখালী বিটসহ বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার হেক্টরের বেশি বনভূমিতে নতুন করে গর্জন, তেলসুর, জাম, আমলকি, বহেরা, অর্জুন, ছাতিয়ান, চিকরাশি, শিমুল, কদম, বক্সবাদাম, কাটাবাদাম, জারুল, পিতরাজ ও আকাশমণিসহ প্রায় ১৫-২০ প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করা হয়।

এর ফলে আবারও বন্যপ্রাণীদের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে৷ স্থানীয়রা বলছেন, তারা এখন নিয়মিতভাবে হাতি, বানর, শিয়ালসহ নানা বন্যপ্রাণীর দেখা পাচ্ছেন, যা আগে বহু বছর অনুপস্থিত ছিল।

থাইংখালী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম জানান, আমরা আগে প্রতি রাতে হাতির আতঙ্কে থাকতাম, কারণ বন না থাকায় তারা বসতির দিকেই চলে আসতো। এখন গাছপালা বাড়ায় তারা আবার বনে ফিরেছে। আমরা শান্তিতে আছি।

তেলখুলা এলাকার আঞ্জু আরা জানান, বনের কারণে অনেকবছর পরে এখন আবার পাখির ডাকে সকাল হয়। বাচ্চাদের নিয়ে নির্ভয়ে চলাচল করতে পারি।

থাইংখালী বিট কর্মকর্তা বিকাশ দাশ জানান, ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে আমরা নিয়মিত গাছ রোপণ ও পাহারার কাজ করেছি। স্থানীয়দের সঙ্গে সমন্বয় করে বন রক্ষায় সামাজিক বনায়নের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এখন অনেক জায়গায় বন্যপ্রাণীর চলাচল দেখা যাচ্ছে, যা ইতিবাচক ইঙ্গিত।

উপজেলা কৃষকদল নেতা সাদমান জামি চৌধুরী জানান, প্রায় ৮ বছর পর উখিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ তার পুরনো রূপে ফিরে আসায় এলাকাবাসীর মাঝে ফিরে এসেছে আশার আলো। এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে একদিন উখিয়ার বনভূমি আবারও হয়ে উঠবে দেশের একটি সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ঐতিহ্য।

পরিবেশ কর্মী জসিম উদ্দিন জানান, বনের ক্ষতি শুধু গাছ বা প্রাণী নয়, জলবায়ু, নদীপ্রবাহ এমনকি মানুষের জীবনযাত্রাতেও প্রভাব ফেলেছে। বনভূমি পুনরুদ্ধারে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টা এখন ফল দিচ্ছে। স্থানীয়দের সহযোগিতা, সরকারি উদ্যোগ ও এনজিওগুলোর সহায়তায় আজ আবার প্রাণ ফিরেছে উখিয়ার বনে। এই বন যাতে ঠিকে থাকে সে ব্যাপারে পাহারাদার ঠিক করতে হবে৷

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, আমরা স্থানীয়ভাবে অনেক সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়েছি। এখন জনগণও বোঝে—বন রক্ষা করা মানে আমাদের জীবন রক্ষা করা। রোহিঙ্গাদের আগমনে স্থানীয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন বন ফিরছে আগের মতো। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় স্বস্তির বিষয়৷

উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল মান্নান জানান, বন পুনরুদ্ধারে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সফল হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই বনভূমি ও জীববৈচিত্র্যকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা। অতীতে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুরোপুরি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, তবে পুনঃবনায়নের মাধ্যমে আমরা অন্তত পরিবেশগত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুল হোসেন চৌধুরী জানান, প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনা আমাদের সকলের দায়িত্ব। আমরা স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেকোনো সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। বনাঞ্চল রক্ষা ও সম্প্রসারণ আমাদের অগ্রাধিকার। স্থানীয়দের সচেতনতা ও বনবিভাগের সমন্বিত প্রচেষ্টায় আজ আমরা আবারও সবুজ উখিয়া দেখতে পাচ্ছি।

চাটগাঁ নিউজ/ইব্রাহিম/এমকেএন

Scroll to Top