বৈঠক শেষে যা বললেন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব

নিজস্ব প্রতিবেদক: হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর সঙ্গে।

শনিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, সব দলই প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আস্থা ও সমর্থন জানিয়েছে।

প্রেস সচিব বলেন, “বৈঠকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনের সময়সীমা, সংস্কার প্রক্রিয়া এবং বিচারব্যবস্থা নিয়ে তিনটি দলই তাদের নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরেছে। ড. ইউনূস আবারও ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করেন।” তিনি আরও বলেন, “কোনো দলই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেনি। বরং সবাই প্রয়োজনীয় সহায়তা ও সময় দিতে প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিয়েছে।”
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, “প্রফেসর ইউনূস স্পষ্ট করে বলেছেন, নির্বাচন জুন মাসের ৩০ তারিখের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। এটি একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা।”

নির্বাচন নিয়ে দ্রুত রোডম্যাপ ও দুই ছাত্র উপদেষ্টাসহ নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ চায় বিএনপি

শনিবার (২৪ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় শুরুতেই বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। বিএনপির পক্ষ থেকে একটি চার সদস্যের প্রতিনিধি দল বৈঠকে অংশ নেয়। দলের পক্ষে নেতৃত্ব দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। অন্য সদস্যরা হলেন- ড. আব্দুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং সালাহ উদ্দিন আহমদ।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নিয়ে বিএনপি নেতারা নির্বাচন বিষয়ে জরুরি রোডম্যাপ প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেন, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্কার কার্যক্রম অবিলম্বে সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট সময়সূচি ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন তারা। বৈঠক শেষে বিএনপির প্রতিনিধি দল একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন।

বিএনপি নেতারা জানান, বৈঠকে তিনটি বিষয়—নির্বাচন, সংস্কার এবং বিচার—প্রধান আলোচ্য হিসেবে উঠে এসেছে। তারা বলেন, পূর্বে অবগত না থাকায় দলীয় পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

বিএনপি নেতারা বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে করা অপরাধের বিচারকে তারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। তারা আরো যোগ করেন, যদি এই সরকারের আমলে সেই বিচার অসম্পন্ন থাকে, তবে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে তা সম্পন্ন করা হবে।

নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বা বিলম্বের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা বলেন, “যেকোনো অজুহাতে নির্বাচন বিলম্ব করা হলে তা জাতির জন্য বিপজ্জনক হবে এবং স্বৈরাচার ফেরার পথ তৈরি হবে। এর দায় বর্তমান সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের বহন করতে হবে।” তারা আরও জানান, নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং দুইজন ছাত্র উপদেষ্টাকে অপসারণের দাবি আগের মতো এবারও লিখিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

বৈঠক করে বিএনপি সন্তুষ্ট কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, এখনো প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস ব্রিফিংয়ের পর প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে জানা যাবে। তখন সন্তুষ্ট কিনা বলতে পারবো। এখন আমাদের দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে।

নির্বাচনের আগে কিছু সংস্কার ও দৃশ্যমান বিচার জনগণের সামনে আনতে হবে: জামায়াত

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্পষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান।

বৈঠক শেষে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, দুটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। প্রথমত, নির্বাচন কখন হবে, তা নিশ্চিত করা দরকার। প্রধান উপদেষ্টা যে সময়সীমা দিয়েছেন, তার মধ্যে যেন কোনো বড় ধরনের জনদুর্ভোগ না হয় এবং একটি গ্রহণযোগ্য সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে কিছু সংস্কার ও বিচার সংক্রান্ত দৃশ্যমান পদক্ষেপ জনগণের সামনে আনতে হবে।”

জামায়াত আমির বলেন, “সংস্কার শেষ না করে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। তবে সব সংস্কার এখন সম্ভব না হলেও, অন্তত পাঁচটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে সন্তোষজনক নিষ্পত্তি প্রয়োজন।”

গত কয়েকদিন ধরে ছড়ানো প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ নিয়ে গুঞ্জনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা কিছু বিষয়ে অসন্তুষ্টি ও বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। এতে সমাজে অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা ও আতঙ্ক তৈরি হয়। যদিও পদত্যাগের কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি, তবে আমরা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি।”

তিনি বলেন, “দেশ আমাদের সবার। আমরা বিশ্বাস করি, আপনারাও এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের মতোই উদ্বিগ্ন ছিলেন। দেশ ভালো থাকলে আমরা সবাই ভালো থাকবো।”

বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি দলে ছিলেন আমির ডা. শফিকুর রহমান এবং নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তারা শনিবার রাত ৮টায় যমুনা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে প্রবেশ করেন এবং বৈঠকে অংশ নেন।

হাসিনার আমলের সব নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা, দ্রুত জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবী এনসিপির

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে শনিবার সন্ধ্যায় ‘যমুনা’ বাসভবনে বৈঠকে অংশ নেয় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একটি প্রতিনিধি দল। বৈঠকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংকট উত্তরণের পথ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

বৈঠক শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, “এই আলোচনা প্রধান উপদেষ্টার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপেরই অংশ। আমরা তাকে বলেছি, যে গণভুত্থান ও পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, সেটি যেন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করেন।”

এনসিপি অভিযোগ করে, “জুলাই ঘোষণাপত্র এখনও প্রকাশিত হয়নি। সরকার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে এটি প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিলেও সময়সীমা পার হয়ে গেছে।” প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে আশ্বস্ত করে বলেন, জুলাই মাসের মধ্যেই ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হতে পারে। এছাড়া এনসিপি জানায়, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। সঞ্চয়পত্র এখনও সব শহীদ পরিবার পায়নি, মাসিক ভাতাও চালু হয়নি। দ্রুত আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে।”

এনসিপি দাবি করে, শেখ হাসিনার শাসনামলের নির্বাচনগুলো ছিল অবৈধ ও জনমতবিরোধী। তারা বলে, “ভোটাধিকার হরণ, রাতের আঁধারে ভোট, অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে পরিচালিত এসব নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করতে হবে।” তারা আরও জানায়, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর তাদের আস্থা নেই। তাই কমিশন পুনর্গঠনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দেয় এনসিপি, যাতে জনগণ সঠিক নাগরিক সেবা পায়।

বৈঠকে এনসিপি বিচার, রাজনৈতিক সংস্কার ও নির্বাচন—এই তিনটি বিষয়ে একটি সমন্বিত রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানায়। তারা বলেন:

  • জুলাই গণহত্যার বিচার
  • সংস্কারের জন্য ‘জুলাই সনদের’ ঘোষণা
  • গণপরিষদ ও আইনসভা নির্বাচনের সময়সূচি

ছাত্র উপদেষ্টা প্রসঙ্গে এনসিপি স্পষ্ট করে জানায়, “অন্তর্বর্তী সরকারের ছাত্র উপদেষ্টারা কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নন। তারা গণভুত্থানের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাই তাদের পদত্যাগ দাবি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক দলকে জড়ানো অনুচিত।”

নাহিদ ইসলাম জানান, “প্রধান উপদেষ্টা কিছুটা হতাশা প্রকাশ করেছেন, কারণ গণভুত্থানের স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়নে বিভিন্ন পক্ষ থেকে চাপ আসছে। অনেকে সেই অঙ্গীকার থেকেও সরে যাচ্ছে, যা সংস্কারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।” এনসিপির পক্ষ থেকে ড. ইউনূসকে আহ্বান জানানো হয়, “তিনি যেন রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে জনগণ ও ছাত্রজনতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, জনগণের আকাঙ্ক্ষাই সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি।”

বৈঠকে নাহিদ ইসলামের সঙ্গে ছিলেন মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব এবং সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা।

চাটগাঁ নিউজ/

Scroll to Top