উজ্জ্বল দত্ত : স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে খুনখারাবিসহ নানা অপরাধে। যে বয়সে লেখাপড়া করে নিজেকে গড়ে উঠার, সে বয়সে তারা একেকজন হয়ে উঠছে দাগি আসামি। পারস্পরিক মতানৈক্য, তুচ্ছ ঘটনায় ঝগড়া-বিবাদের জেরে হামলা, প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠছে তারা। কচি হাতে খুন করছে সহপাঠীকেও। একের পর এক ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনায় অভিভাবকমহল রীতিমত স্তম্ভিত ও শঙ্কিত।
গতকাল ২৯ এপ্রিল স্কুল ছুটির পর চার বন্ধু মিলে পূর্ব শত্রুতার জেরে চান্দগাঁও সানোয়ারা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. রাহাত ইসলাম চার সহপাঠীদের হামলায় নিহত হন। সহপাঠীরা তাকে মেরে কর্ণফুলীতে ফেলে দেয়। আজ বুধবার (৩০ এপ্রিল) সকাল ৭টায় আটককৃতদের দেয়া তথ্যমতে, নগরের কর্ণফুলী নদীর হামিদচর বিল এলাকা থেকে রাহাত ইসলামের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ চার শিক্ষার্থীকে আটক করেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাহাতকে পিঠিয়ে হত্যায় তার সহপাঠীরাসহ মোট ১৩ জন অংশ নেয়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর ওই দলের পাঁচ সদস্য রাহাতের মরদেহটি নদী সংলগ্ন হামিদচর বিলে ফেলে পালিয়ে যায়। ক্রিকেট খেলা নিয়ে মাস খানেক আগে সহপাঠীদের সাথে তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে রাহাতের। পরবর্তীতে রাহাতের মা নিজে দাঁড়িয়ে তার সহপাঠীদেরকে নিয়ে এই ঘটনার সমাধান করে উভয়পক্ষকে মিলিয়েও দেন। কিন্তু ক্ষুব্ধ সহপাঠীরা এতে খুশি হননি। তাদের মাথায় খেলতে থাকে রাহাতকে হত্যার পরিকল্পনা। অবশেষে গতকাল স্কুল ছুটির পর সেই বন্ধুরা রাহাতকে হামিদচরে ঘুরতে যাবার কথা বলে নিয়ে যায়। এরপর ওই বন্ধুদের হায়ার করা কিশোর গ্যাং সদস্যসহ মোট ১৩ জন মিলে রাহাতকে পিটিয়ে হত্যা করে।
গত ২১ এপ্রিল ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ উপজেলার লটখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে বেঞ্চে বসা নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে মো. রাব্বি আহমেদ ও মো. ইউসুফ নামে দুই শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করে তাদেরই সহপাঠী মশিউর রহমান।
সপ্তাহের ব্যবধানে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘটিত ঘটনা দুটি নিয়ে গণমাধ্যম, সোস্যাল মিডিয়াসহ অভিভাবক সমাজে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করছেন, স্কুল পড়ুয়াদের নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে অস্ত্র নিয়ে হামলা ও হত্যার মানসিকতা প্রজন্ম ধ্বংসের অশনি সংকেত। অসাধু রাজনৈতিক চক্র নিজেদের স্বার্থে কোমলমতি কিশোরদেরকে কর্মী হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের হাতে অস্ত্র, অর্থ তুলে দিয়ে নানামুখী অপরাধ করাচ্ছে। আটক বা গ্রেফতার হলেও নেতারাই ছাড়িয়ে আনছেন। ছাড়িয়ে এনে পরবর্তীতে আবার অপরাধে যুক্ত করাচ্ছেন।
মিডিয়া সেলিব্রেটি ও সিপ্লাসটিভির প্রধান সম্পাদক আলমগীর অপু বলেন, চান্দগাঁওয়ে রাহাত ইসলামকে পিটিয়ে হত্যার মত এমন নৃশংস ঘটনা এখন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হচ্ছে! স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিশোধের নেশা, আবার দলবদ্ধ হয়ে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করা, ফলশ্রুতিতে এমন একটি ফুটফুটে খেলাধুলায় অসম্ভব পারদর্শী ছেলের চলে যাওয়া- এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কয়েকদিন আগে ঢাকায় একটি স্কুলের ভেতরে দুই সহপাঠীকে ছুরিকাঘাত করেছে তাদেরই এক সহপাঠী।
তিনি বলেন, মূলত আমাদের প্রায় প্রতিটি স্তরে অস্থিরতা বিরাজ করছে! ছোট ছোট বাচ্চা শিশু-কিশোররা এমন সব আচরণ করছে যা জীবনে কল্পনাও করিনি। শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবি, আচার-আচরণে ভাব সাবে কেমন জানি! আমরা ভয়াবহ এক ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ ইমাম আলী বলেন, এমন পরিস্থিতির জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। একটি কারণ- পারিবারিক শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়া। অভিভাবকরা অনেকেই এখন সৎ জীবন যাপন করছেন না। সবাই অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতার পিছনে ছুটেছেন। আর সন্তানরা অভিভাবকদের এমন অসৎ, অনৈতিক জীবনযাপন দেখে বেড়ে উঠছে। অসৎ, অনৈতিক জীবনযাপনের প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
‘দ্বিতীয় কারণ- সম্পদের অসম বিন্যাস। আমাদের সমাজে একদিকে প্রাচুর্য আর অন্যদিকে দারিদ্র্য। তৃতীয় কারণটি হচ্ছে- সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জুনিয়র প্রজন্ম সিনিয়রদেরকে সম্মান, সিনিয়র প্রজন্ম জুনিয়রদেরকে স্নেহ, ভালবাসা প্রদর্শন করছে না। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মানবোধ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা সন্তানদের কাছ থেকে ভালো রেজাল্ট চাই। কিন্তু ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলেও তা হয়ে উঠছে না। ওই যে আমাদের অসৎ জীবনধারা। ’
তিনি বলেন, ‘সন্তানকে ভাল হতে বললেও সে তো জানে যে আমি কিভাবে জীবন লিড করছি। চতুর্থ কারণ- আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। এখন ছাত্রদের ভয়ে শিক্ষকরা ভীত। ছাত্ররা বুক ফুলিয়ে বলে, আমরা ওই শিক্ষককে মেরেছি। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা ছিল না। এমনটা কেন হচ্ছে? এই দায় কার?
চাটগাঁ নিউজ/এসএ