ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছে ‘শয়তানের নিঃশ্বাস’— পলকেই লুটে নিচ্ছে সর্বস্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক : মো. সুমন হোসেন (২৮)। রাইড শেয়ারিং অ্যাপস পাঠাওয়ের মাধ্যমে বাইক চালাতেন। ভালো চাকরির আসায় পথে পথে ঘুরেও কোন কূল কিনারা না পেয়ে আর্থিক অনটনে এক প্রকার বাধ্য হয়েই আসতে হয় এই পেশায়। রাইড শেয়ার করে কোন রকম দিন পার করছিলেন সুমন।

তবে দুঃখ যেন তার পিছু ছাড়তে চায় না। কোন এক দুষ্কৃতি চক্রের হাতে পড়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই হারাতে হয় তার উপার্জনের একমাত্র সম্বল বাইকটি।

জানা যায়, প্রতিদিনের মতো নগরীর অক্সিজেন মোড় এলাকায় যাত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন সুমন হোসেন। এরই মধ্যে যাত্রীবেশে একজন এলে কোথায় যাবেন জিজ্ঞেস করতেই ওই ব্যক্তি পকেট থেকে একটি কাগজ বের করেন। বলেন, কাগজে ঠিকানা লেখা আছে। সুমন কাগজটা হাতে নিতেই তার আর কিছু মনে নেই।

সুমনের যখন হুঁশ ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করেন রাস্তার ধারে দাড়িয়ে আছেন। তার উপার্জনের একমাত্র সম্বল বাইকটি সাথে নেই। পকেটের মোবাইল ফোনটাও খুঁজে পাননি তিনি।

জানা যায়, সুমনের সাথে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় ব্যবহার করা হয়েছে ভয়ঙ্কর এক মাদক, নাম স্কোপোলামাইন। তবে বিশ্বজুড়ে ‘ডেভিলস ব্রেথ’ নামেই বেশ পরিচিত। এই মাদকের রয়েছে মানুষের মগজকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। এছাড়াও অপরাধী চক্রগুলো এই মাদকের সাহায্যে সাধারণ মানুষকে মুহূর্তেই বশীভূত করে সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, স্কোপোলামাইন মূলত একটি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি, যা শ্বাস, স্পর্শ এবং খাবারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। এর ফলে ব্যবহারকারীকে অজ্ঞান করে দিয়ে অপরাধী চক্রের সদস্যরা তাদের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মাদকটি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার করলে এটি মানুষের শরীরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় এই মাদকটির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাধারণ জনগণ।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় একটি ফার্মেসিতে প্রতারণার শিকার হন পল্লব মজুমদার। অপরিচিত এক ব্যক্তি করমর্দনের মাধ্যমে এই মাদক প্রয়োগ করে তার কাছ থেকে সবকিছু লুটে নেয়।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর রবিউল ইসলাম বলেন, এটি একটি শক্তিশালী ড্রাগ, যা মানুষের মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ধ্বংস করে এবং তাকে পুরোপুরি অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। চট্টগ্রামে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে। সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি।

ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের নিঃশ্বাস কী

নাইটশেড গোত্রভুক্ত উদ্ভিদ (যেমন রাজঘণ্টা, ধুতুরা)-এর পাতা থেকে ট্রোপেন অ্যালকালয়েড নামক এক ধরনের শক্তিশালী জৈব যৌগ পাওয়া যায়। কথিত আছে প্রাকৃতিকভাবে উৎসরিত এই নির্যাসটি মানুষকে জোম্বি বা জিন্দালাশে পরিণত করে। আর তাই উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্কোপোলামিন নামে অভিহিত এই রাসায়নিক বস্তুটি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে শয়তানের নিঃশ্বাস বা ডেভিলস ব্রেথ নামে।

তবে এমন অদ্ভূত নামের জন্য দায়ী এর অ্যান্টিকোলিনার্জিক বৈশিষ্ট্য। এর ফলে মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর পারস্পরিক বার্তা আদান-প্রদানের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। তাই এটি অতি অল্প মাত্রায় মোশন সিকনেস এবং অত্যধিক বমির চিকিৎসায় ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে পরিমিত মাত্রায় আরোগ্য দানকারী এই ঔষধই অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বিষ হয়ে ওঠে। এর নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যে রয়েছে মস্তিষ্ক বিভ্রম, হ্যালুসিনেশন এবং ঝাপসা দৃষ্টি। এমনকি এর মাত্রাতিরিক্ত সেবনে চরম পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট, হার্ট-অ্যাটাক ও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা এই মাদকটি বিদেশ থেকে আমদানি করে অন্যান্য মাদকদ্রব্যের সাথে মিশিয়ে বিক্রি করছে। ইতোমধ্যেই পুলিশ বেশ কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে এবং তাদের কাছ থেকে কিছু পরিমাণ “ডেভিলস ব্রেথ” উদ্ধার করেছে।

গোয়েন্দা বিভাগের আরেক কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি কায়সার জানান, এই মাদক সাধারণত হ্যান্ডশেক, কাগজের টুকরো, চিরকুট, এমনকি খাবারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকেও শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। তরল বা পাউডার দুই ফরম্যাটেই এটি পাওয়া যায় এবং এর প্রভাব ২০ থেকে ৬০ মিনিট স্থায়ী হতে পারে। খাবারের মাধ্যমে প্রবেশ করালে এর প্রভাব দু-তিন দিনও থাকতে পারে।

‘ডেভিলস ব্রেথ’ থেকে বাঁচতে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডা. আফলাতুন আকতার জাহান বলেন, রাস্তা বা যানবাহনে চলাচলের সময় অপরিচিত কারো কাছ থেকে খাবার বা পানীয় গ্রহণ না করা। কেউ কোনো কাগজ বা ভিজিটিং কার্ড মুখের সামনে ধরলে সতর্ক থাকা। মাস্ক ব্যবহার করলে এটি শ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ প্রতিরোধ করতে পারে। আক্রান্ত হলে দ্রুত নিকটস্থ থানা বা হাসপাতালে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ড্রাগ। এটি শ্বাস, স্পর্শ বা খাবারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে নিয়ন্ত্রণে এনে সর্বস্ব লুট করে নেয়। তাই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’

সিএমপি কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ইন্সপেক্টর মো. আফতাব হোসেন বলেন, ‘ড্রাগটির প্রভাব এতটাই শক্তিশালী যে অপরাধীরা মানুষের মন নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম। সচেতনতার পাশাপাশি মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এটি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, আমরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছি। সমাজ থেকে সব ধরণের নেশা নির্মূল করতে আমরা বদ্ধপরিকর।

চাটগাঁ নিউজ/এইচএস/এসএ

Scroll to Top