উখিয়া প্রতিনিধি: বকুলবালা। বাড়ি ছিলো মিয়ানমারের ফকিরবাজার এলাকায়। বকুলবালার মেয়ের বিয়ে হয়েছিল চিকনছড়িতে। বকুলবলার স্বামী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) চিকনছড়িতে গিয়েছিলেন মেয়ে-জামাইকে দেখতে। সেখানেই তিনি নিহত হন মিয়ানমারের সৈনিকদের গুলিতে। ওইদিন আরও নিহত হয় বকুলবালার মেয়ে-জামাই এবং নাতিসহ বহু আত্মীয়স্বজন।
সেদিন অন্য আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে বাংলাদেশ পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন কুতুপালং হিন্দু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে৷ মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে দেশান্তরী হয়ে বকুলবালাকে মৃত্যু হয়তো তাড়া করে ফেরে না, কিন্তু ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা, স্বস্তি-সুখ কিছুই দিচ্ছে না।
শুধু বকুলবালা নয়, বকুলবালার মতো আরো পাঁচ শতাধিক হিন্দু রোহিঙ্গা আশ্রয় নেন কুতুপালং ক্যাম্পে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বিপুল সংখ্যাক মুসলমানের সঙ্গে হিন্দুরাও এসেছিল। এসেছিল খ্রিস্টানও। কুতুপালংয়ের এই ক্যাম্পে সব হিন্দু রোহিঙ্গার ঠাঁই হয়েছে, তা্ই এটা হিন্দু ক্যাম্প নামে্ই পরিচিত। মিয়ানমবার থেকে আসার পার চলে গেছে ছয় বছরেরও বেশি সময়। এ্ই ছয়টি বছর কেমন কাটলো সেসব জানতে্ই সম্প্রতি এই প্রতিবেদক সরেজমিন কথা বলেছেন কুতুপালং হিন্দু ক্যাম্পের অধিবাসীদের সঙ্গে।
যাদের একজন রতন কান্তি। তিনি বলেন, আমাদের গুলি করেছে। ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছে। ভাত-পানি খেতে দেয়নি। আমরা হিন্দু মানুষ। আমাদের মেরেছে-কেটেছে। আমাদের মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। সেই জন্য আমরা চলে এসেছি। এক গ্রাম থেকেই আমরা চারশো জনের মতো এসেছি। যারা মারতে এসেছিল, ওরা কালো পোশাক পরে এসেছিল। ওদের চিনি না। শুধু চোখ দেখা যাচ্ছিল।
রিকটা গ্রাম থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশু শিবকুমার নামে আরেকজন জানিয়েছেন, তার মা বাবা খালা সবাইকে হামলাকারীরা মেরে ফেলেছে। হিন্দু মুসলমান সবাইকে মেরেছে। গুলি করেছে। ওরা কালো পোশাক পরা ছিল। আমি চিনি না। চারিদিক থেকে ঘেরাও করে আমাদের মারছে। হিন্দু মুসলমান সবাই এক সঙ্গে পালিয়ে এসেছি।
কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের কাছে একটি মন্দিরের পাশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় পাঁচশো রোহিঙ্গা হিন্দু নারী-পুরুষ-শিশু। তারা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন শুরু হলে মুসলিম রোহিঙ্গার পাশাপাশি হিন্দু রোহিঙ্গাও পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা।
ক্যাম্পের মধুবালা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ’আমরা এই ক্যাম্পে কাঁটাতারের মধ্যে আর থাকতে চাই না৷ আমরা আমাদের নিজ দেশে ফিরতে চাই৷ আমাদের ফেলে আসা ভিটেমাটি দেখতে চাই৷ কারাবন্দী জীবন থেকে মুক্তি চাই৷ ‘
রুপন নামে আরও এক রোহিঙ্গা জানান, “আমি মিয়ানমার থেকে একা এসেছিলাম।এখানে এসে বিয়ে করি, বর্তমানে ৫ সদস্যের একটি পরিবার আছে৷ আমাদের যে সহযোগিতা করা হয় সে সহযোগিতা বা রেশন দিয়ে আমরা ৫জন ১২ থেকে ১৬ দিন কোনো রকম খেতে পারি৷ বাকী দিনগুলোর জন্য চিন্তায় ঘুম হয় না৷ কাঁটাতারের বাহিরে কাজ করতে গেলেও চেকপোস্টে নামিয়ে ফেলে৷ বাকীদিনগুলো ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে৷”
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভি শর্মার কাছে ক্যাম্প এবং স্থানীয়দের মাঝে সামাজিক সম্প্রীতি বিষয় জানতে চাইলে তিনি জানান আমরা এখন বাংলাদেশী মুসলিম, হিন্দু এবং রোহিঙ্গা হিন্দুদের মধ্যে কোন ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছে না। মিয়ানমারে আমরা যেসব লক্ষ্য করেছি কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ভিন্ন৷ তাই আমরা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই। তবে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাওয়ার ইচ্ছেটাও গোপন করেন না তিনি। বলেন- এটা কোন জীবন নয়, অন্যের দয়ায় আর কতকাল বাঁচবো?
তিনি আরও বলেন, আমাদের ক্যাম্পে দুর্গা পূজা ছাড়া অন্যপূজা গুলো তেমন করা হয় না৷ আমাদের দেশে (মিয়ানমার) ফিরতে পারলে স্বাধীন ভাবে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, উন্মুক্ত যাতায়াতের পাশাপাশি ধর্মীয় কাজগুলোও করতে পারবো।
পাঁচ বছরের শিশু স্বপ্না জানান, “আমার জন্ম কুতুপালং হিন্দু রোহিঙ্গা শিবিরে, আমার এখানে মা-বাবা ভাই-বোন আছে কিন্তু দাদা-দাদি এবং নানা-নানি কেউ এখানে নাই৷ আমি তাদের কথা শুনেছি কিন্তু দেখি নাই৷ আমি আমার দেশে মিয়ানমারে দাদা-দাদি এবং নানা-নানির সবাই মিলে থাকতে চাই৷ তাই আমাদের প্রত্যাবাসন করার জন্য অনুরোধ করছি।”
উখিয়ার কুতুপালং হিন্দু ক্যাম্পের মাঝি কাজল শীল জানান, “আমাদের ক্যাম্পে ১২৩ পরিবার নিয়ে ৫০৩ রোহিঙ্গা আছে৷ তার পাশে রয়েছে বাংলাদেশী হিন্দু এবং মুসলিম৷ আমরা একই পরিবারের মতো করে ৭ বছর ধরে বসবাস করে আসছি৷ আমাদের মধ্যে কোনো দাঙ্গা সংঘটিত হয়নি৷ তবে আমরা এভাবে শরনার্থী হয়ে থাকতে চাই না৷ এবার নিজ দেশে ফিরতে চাই।