কাপ্তাই প্রতিনিধি: পাহাড়ের দুর্গম ও প্রত্যন্ত জনপদে শিক্ষার আলো ছড়াতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কতৃক টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলায় পরিচালিত হয়ে আসছে প্রায় ৪ হাজার ৮শতটি পাড়া কেন্দ্র। যার মধ্যে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলাতে রয়েছে ১৫০টি পাড়া কেন্দ্র।
যেই কেন্দ্রগুলো দুর্গম অঞ্চলের শিশুদের বিকাশ ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে আসছে। পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের মাতৃস্বাস্থ্য, পুষ্টি উন্নয়ন, নিরাপদ পানি সরবরাহ, সংক্রমক ব্যাধি, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও নির্যাতন প্রতিরোধ, কিশোর-কিশোরী সহায়ক কার্যক্রম সহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছে।
তবে ২০২৩ সালের ৩০ জুন এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে কর্মরত পাড়াকর্মীদের সম্মানী বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে প্রায় ৩ মাস ধরে সম্মানী বন্ধ থাকলেও পাড়াকর্মীরা পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে কখন থেকে আবার প্রজেক্ট নতুন করে চালু হবে এবং সম্মানী ভাতা দেওয়া শুরু হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করছে পাড়া কর্মীরা।
এদিকে ৩ মাস সম্মানী ভাতা বন্ধ থাকার ফলে সীমাহীন আর্থিক সংকটে দিন কাটছে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার ১৫০টি পাড়াকেন্দ্রে ১৫০ জন পাড়াকর্মীর পরিবারের।
সম্প্রতি কাপ্তাইয়ের বেশ কয়েকটি দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে পাড়াকর্মীদের সাথে কথা হলে তারা অধিকাংশই জানান, জুলাই মাস থেকে তাঁরা সম্মানী পাচ্ছেন না। এর মধ্যে বেশির ভাগ পাড়াকর্মী দরিদ্র পরিবারের। যার ফলে পাড়াকেন্দ্রের সম্মানী দিয়ে অনেকের সংসার চলে। কিন্তু তিনমাস সম্মানী না পাওয়াতে সংকটে রয়েছেন তাঁরা। এদিকে সম্মানী বন্ধ থাকলেও পাড়াকেন্দ্রের কার্যক্রমও চালু রয়েছে। ফলে, যথা নিয়মে পাড়া কেন্দ্রে তাদের সময় দিয়ে যাচ্ছেন।
এবিষয়ে কাপ্তাইয়ের ওয়াগ্গা ইউনিয়ন এর নোয়াপাড়া পাড়াকেন্দ্রের কর্মী সুইক্রাইং মারমা জানান, আমি ১৯৯৯ সাল থেকে পাড়াকর্মীর দায়িত্ব পালন করে আসছি। এবং এই পাড়াকেন্দ্র থেকে মাসিক ৭ হাজার টাকা সম্মানী দিয়ে আমার সংসার খরচ চলে। তবে তিনমাস সম্মানী বন্ধ থাকার ফলে চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মেয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাও সম্মানী বন্ধ থাকলেও পাড়াকেন্দ্রের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
অন্যদিকে কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন এর মিতিঙ্গাছড়ি পাড়াকেন্দ্রের পাড়াকর্মী স্বপ্না মারমা জানান, তিনমাস সম্মানী না পাওয়ার কারণে বিভিন্ন জন থেকে ধার-দেনা করে কোনমতে সংসার চালাচ্ছেন। দ্রুত সময়ে সম্মানী ভাতা চালু না হলে সংসারের সমস্যা আরো বাড়বে।
এদিকে কাপ্তাই ৮ নং ক্লাস্টার এর মাঠ সংগঠক রত্না প্রভা চাকমা জানান, আমরা মূলত এই পাড়াকেন্দ্রের পাড়াকর্মীদের মাধ্যমে দুর্গম এলাকাগুলোতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি বিষয়ক সেবাগুলো প্রদান করে থাকি।
পাশাপাশি আমরা বাড়ি পরিদর্শন ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেই। তিনি আরও বলেন, আমরা উঠান বৈঠকে এলাকার প্রসূতি, গর্ভবতী ও কিশোরীদের অংশগ্রহণ করানোর সঙ্গে শিশুদের অভিভাবকদেরও রাখি। বৈঠকে আমরা স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিশু সুরক্ষা এই তিনটি বিষয়ের ওপর খুব জোর দেই। স্বাস্থ্যের মধ্যে টিকা দেওয়া, নিয়মিত চেকাপ করানো, পুষ্টির মধ্যে সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং শিশু সুরক্ষার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, টিকা দেওয়ার বিষয়গুলো নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। পাশাপাশি এলাকার অনেক কিশোরী এই পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক তথ্য পাচ্ছে। তবে পাড়াকর্মীদের মতো আমাদের ও সম্মানী ভাতা বন্ধ রয়েছে। এতে আমরা আসলে সকলেই খুব চিন্তায় এবং কষ্টে দিনযাপন করছি।
এ বিষয়ে কাপ্তাই উপজেলার সহকারি প্রকল্প ব্যবস্থাপক চিংসাঅং মারমা জানান, প্রতিদিন যখন আমরা বিভিন্ন পাড়াকেন্দ্রে পরিদর্শনে যাই তখন পাড়াকর্মীরা অসহায় মুখ নিয়ে আমাদের জিজ্ঞেস করে কখন সম্মানীভাতা পাবো। তখন আসলে খুব কষ্ট হয় উনাদের দেখে। আমরা তাঁদের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছি দ্রুত সময়ে এই সমস্যা সমাধান হবে। পাশাপাশি পাড়াকর্মীরা কিন্তু বিনা সম্মানীতে এখনো পাড়াকেন্দ্র চালিয়ে যাচ্ছে যেন মাঝপথে শিশুরা শিক্ষা অর্জনে ঝরে না পড়ে। আমরাও সেই লক্ষে কাজ করে যাচ্ছি।
এদিকে টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের কাপ্তাই উপজেলা প্রকল্প ব্যবস্থাপক মৃদুল চৌধুরীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, এই প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রনালয়ে ডিপিপি জমা দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শীঘ্রই এটি অনুমোদন হবে। এবং অনুমোদনের পর পাড়াকর্মী এবং মাঠ সংগঠক সহ সকলে আবারো নিয়মিত সম্মানী ভাতা পাবেন।
প্রসঙ্গত, কাপ্তাই উপজেলার ১৫০টি পাড়া কেন্দ্রে দুই হাজারেরও অধিক শিশু প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে যাচ্ছে।