চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এখনও ফলাফল হয়নি। যদিও চলমান রয়েছে ভোট গণনা। তবে এখনও শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাজ করছে নানা আশঙ্কা ও উদ্বেগ।
এদিকে দ্রুত ফলাফল প্রকাশের জন্য শিক্ষার্থীরা সিনেট ভবনের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেছেন। আজ শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৫টা থেকে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। পরে শিক্ষার্থীদের চাপে রাত ৮টার দিকে হল সংসদ শেষ করে কেন্দ্রিয় সংসদের ভোট গণনা শুরু করা হয়।
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে শুরু হয় ভোটগ্রহণ। বিকেল ৫টায় নির্বাচন শেষ হওয়ার কথা থাকলেও রাত সোয়া ৮টা পর্যন্ত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল ও তাজউদ্দীন আহমদ হলে ভোট গ্রহণ করা হয়। এছাড়া বাকি ১৯টি হলেও ৫টার পরে কিছু সময় ভোটগ্রহণ চলে।
ভোটগ্রহণের শেষ হওয়ার পরে রাত সোয়া ১০টার দিকে হল সংসদের ভোট গণনা শুরু হয়। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার পরও হল সংসদের ভোট গণনা চলছে। শুরু হয়নি কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণনা। প্রার্থীরা বলছেন, হল সংসদের ভোট গণনা এখনও শেষ হয়নি। তাহলে কবে শুরু হবে কেন্দ্রীয় সংসদের ভোটগণনা? যদি এমন হয় তাহলে ফল প্রকাশ কবে হবে; তা অনেকটাই অনিশ্চিত।
এদিকে রাতের মধ্যেই জাকসু কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন প্রার্থীরা। তাদের দাবি মেনে না নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে নিজেদের দাবি জানাতে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু ও ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের’ জিএস প্রার্থী মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। এই মুহূর্তে কমিশনের সামনে প্রার্থীরা অবস্থান নিয়েছেন।
এদিকে বিকেলে নির্বাচন কমিশনে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান। তিনি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করছেন বলে জানা গেছে।
স্বতন্ত্র সদস্য প্রার্থী শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন— আমরা বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলেছি যে, তারা যেন সুন্দরভাবে জাকসু নির্বাচনটা করে। আমরা এ বিষয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছি এবং প্রশাসনকে সহায়তা করেছি। একটি গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র প্রতিফলিত করতে প্রশাসনকে প্রভাবিত করছে। ওএমআর মেশিন তো কোনো দলের হতে পারে না। এই প্রশাসন যদি পূর্ণাঙ্গভাবে আগে মেশিনগুলো পরীক্ষা করে নেয়; তাহলে সেটাতে সবার যদি মত থাকে তবে তাতে প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক বলে মনে করি না। আমরা মনে করি, অতিদ্রুত প্রশাসন ফলাফল দিবে। এ সময় তার সমর্থকরা দ্রুত ফলাফল প্রকাশের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন।
এ বিষয়ে বিএনপিপন্থি শিক্ষক ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শিবিরের জিএস প্রার্থীর অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমরা তিনজন শিক্ষক গতকাল বিকেলে ভোট বর্জন করে বাসায় এসেছি। বাসা থেকে বের হয়নি। এখান থেকে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র বা পরিকল্পনার সুযোগ নেই। বরং শিবিরের জিএস প্রার্থীর বক্তব্যে আমরা ষড়যন্ত্র খুঁজে পাচ্ছি। তারা ওএমআর মেশিনে ভোট গণনার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এই ওএমআর মেশিন আর ব্যালট জামাতের একজন নেতার মাধ্যমে ছাপানো হয়েছে। ইতিমধ্যে ডাকসু নির্বাচনে ওএমআর মেশিনের মাধ্যমে ভোটগণনায় প্রশ্ন উঠেছে। আর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকের সাথে ঢাবি ভিসির ছবি আছে। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন সেখানে সবাই শিবির।
স্বতন্ত্র প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় জাকসু ও হল সংসদের ভোট গ্রহণ শেষ হয়। একদিন পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনও ফলের আশায় বসে আছি। বিভিন্ন মহল ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। আমরা দেখেছি, শিক্ষকদের একটি বিশেষ গোষ্ঠী জাকসু বাস্তবায়িত হোক, তা চাননি। ছাত্ররা নিজেদের ফোরামে বসে দাবি-দাওয়া উত্থাপন করুক, তা একটি গোষ্ঠী চায় না। কোনো শিক্ষক যদি জাকসুর ফল স্থগিতের দুঃসাহস দেখান, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
শিবিরের জিএস প্রার্থী মাজহার বলেন, আমরা দুইটি বিষয় নিয়ে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে যাচ্ছি। প্রথম ভোট গণনা চালু এবং জাকসুর ফল স্থগিতের ম্যান্ডেট না নেওয়া।
এর আগে বিকেল ৪টা ৩৭ মিনিটে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের’ জিএস পদপ্রার্থী মাজহারুল ইসলাম বলেন, এটা দুঃখজনক যে, নির্বাচনের ২৪ পেরিয়ে যাওয়ার পর কেবল হল সংসদের ভোট গণনা করা হয়েছে। হল সংসদের চেয়ে জাকসুর ভোটের পরিমাণ দ্বিগুণ। তাহলে আরও দুইদিন পর ভোট গণনা শেষ হবে?
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, একটি মহল জাকসুর ভোট গণনা ব্যাহত করতে চাচ্ছে। তারা শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেটের ওপর আস্থা রাখতে চাচ্ছে না। আমরা এই ফল না নিয়ে কোথাও যাবো না।
বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত প্যানের সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক আহসান লাবিব বলেন, আজ রাত ৮টার মধ্যে জাকসু ও হল সংসদের ফল ঘোষণা করতে হবে। প্রয়োজনে গণনার কাজে লোকবল বাড়াতে হবে। এছাড়া মেশিনেও ভোট গণনা করা যেতে পারে। কেননা নির্বাচন বয়কট করা ছাত্রদলের দাবির প্রেক্ষিতে ম্যানুয়ালি ভোট গণনা করার সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হাস্যকর।
এর আগে গতকাল সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ভোটগ্রহণ। দিনভর অব্যবস্থাপনার থাকলেও নির্দিষ্ট সময় পার করেও উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীরা ব্যালটের মাধ্যমে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন। তবে ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট বক্সগুলো সিলগালা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন দপ্তরে রাখা হলেও গণনার কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি।
ভোটগ্রহণের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও ফলাফল ঘোষণার উদ্যোগ না নেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তারা অভিযোগ করছে, তাড়াতাড়ি গণনা শুরু না করা প্রশাসনের ষড়যন্ত্রের একটা অংশ। অনেকে বলছেন, নির্বাচন কমিশনের গড়িমসি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
এদিকে শিবির সমর্থিত প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী আরিফ উল্লাহ বিকেল ৬টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক একটি পোস্টে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলার অভিযোগ তুলেছেন। তিনি ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘জাকসু নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। প্রশাসন যেকোনো মূল্যে জাকসুকে অকার্যকর করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলি, আপনারা সকলে সিনেট ভবনে জমায়েত হোন। আপনাদের ভোটের ফলাফল নিজেদের হাতে বুঝে নিতে হবে। ফলাফল না নিয়ে সিনেট ভবন থেকে এক পা-ও নড়বেন না। জাকসু বানচালের এই ষড়যন্ত্র আমাদের একজোট হয়ে ব্যর্থ করে দিতে হবে ইনশাআল্লাহ।’
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, দুপুরের পর থেকে ভোট গণনা বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আবার ম্যানুয়ালি ভোট গণনা শুরু হয়েছে।
ফলাফল বিলম্বিত হওয়ায় ক্যাম্পাসে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা দ্রুত ব্যালট বক্স খোলা ও স্বচ্ছভাবে ভোট গণনার দাবি জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাকসু নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কয়েকজন পোলিং অফিসার জানান, ভোট গ্রহণ সুষ্ঠুভাবে হয়েছে, তবে গণনায় দেরি হলে তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ তৈরি হয়। নির্বাচন কমিশনের এমন অব্যবস্থাপনায় আমরা শিক্ষকরাও অতিষ্ঠ।
ওএমআরে ভোট গণণা না করে হাতে ভোট গণনার প্রতিবাদ জানিয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সুলতানা আক্তার বলেন, আমরা আমাদের সহকর্মীর লাশের ওপর দিয়ে আর ভোট গণনা করবো না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু আমাদেরকে দিয়ে দুইদিন যাবত অমানবিক পরিশ্রম করানো হচ্ছে। দুইদিন ধরে না ঘুমিয়ে আমরা কাজ করছি। এর কারণে আমরা আমাদের একজন সহকর্মীকে হারিয়েছি। এখনো যে পরিমাণ ব্যালট আছে; তা গণনা করতে ৩ দিন সময় লাগবে। আমরা অনতিবিলম্বে ওএমআর পদ্ধতিতে ভোট গণণা করতে চাই।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব একেএম রাশিদুল আলম বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে যেসব কারণে ভোট গণনায় দেরি হয়েছিল, সেগুলো আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। আমরা আশা করছি যে, এই প্রস্তুতি নেওয়ার ফলে এবং আজ যে লোকবল আছে, তাতে আমরা হয়তো বিকেল নাগাদ হলের ভোট গণনার হিসাব শেষ করতে পারব এবং রাত ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে আমরা সম্পূর্ণ গণনা সম্পন্ন করে বেসরকারিভাবে ফল প্রকাশ করতে পারব।’
এদিকে ভোট গণনা বন্ধ করে আলোচনার টেবিলে উপাচার্যসহ বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা। অন্যদিকে দ্রুত ফলাফল প্রলাশের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নির্বাচন কমিশন অফিসের সামনে অবস্থান নিচ্ছে।
চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ