চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর দখল নেয়ার কয়েক দিন পর এসে অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সোমালি জলদস্যুরা। এতদিন জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সাথে যোগাযোগসহ ও অন্যান্য কিছু সুবিধা দিলেও গত দুই দিনে তারা সেটিও বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে তাদের পরিবার।
নাবিকরা তাদের পরিবারকে জানিয়েছেন, জলদস্যুরা জাহাজে থাকা খাবার শুধু খাচ্ছেই না, সেগুলো নষ্টও করছে। এটি দুশ্চিন্তার কথা জানান জিম্মি নাবিকরা।
জিম্মি থাকা ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের ওমর ফারুক মঙ্গলবার জানান, তখন সে জানিয়েছিল জলদস্যুরা প্রতিদিন প্রায় ১০০ জনের খাবার নষ্ট করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বড় সংকটে পড়তে হবে তাদের।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এমভি আব্দুল্লাহ এবং জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতীয় কমান্ডোরা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করার পর এমভি আব্দুল্লাহতেও অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে এই ধরনের অভিযানের প্রস্তাবে বাংলাদেশের সরকার রাজি হয়নি।
জাহাজটির মালিক কোম্পানি কেএসআরএম গ্রুপও এই ধরনের অভিযানে রাজি নয়।
প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘যে অভিযানে নাবিক ও ক্রুদের জীবন বিপন্ন হয় এমন কোনো অপারেশন আমরা চাই না।’
জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম বলেন, ‘ভারতীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার দেখার পর থেকে ওরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে আমরা জেনেছি। অভিযান চললে আমরা আর আমাদের সন্তানদের জীবিত ফেরত পাবো না। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।’
এখন কোথায় আছে জাহাজটি?
পরিবারের সাথে যোগাযোগ না থাকলেও জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণের থাকা জাহাজটির সর্বশেষ অবস্থান মনিটর করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নৌপরিবহন অধিদফতরের পাশাপাশি বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনও (বিএমএমওএ) জাহাজটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে।
দস্যু বাহিনী জাহাজটিকে নিয়ে কয়েক দফায় ভারত মহাসাগরে স্থান পরিবর্তন করে।
জাহাজটির এই গতিপথ ও অবস্থান দেখে বিএমএমওএ বলেছে, জাহাজটি জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর প্রথমেই তারা বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজটিকে দেড় দিনের মাথায় সোমালিয়া উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে যায়।
জলদস্যুদের কবলে পড়ার পরদিন বুধবার এটি ছিল সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু উপকূলের কাছাকাছি অবস্থানে। পরবর্তীতে সেটিকে আরো উত্তর দিকে সরিয়ে প্রথমে নেয়া হয় গারদাকে।
এরপরই ভারতীয় নৌবাহিনী জাহাজটি ঘিরে নজরদারি বাড়ালে সেটি আবারো সরিয়ে নেয়া হয় গদবজিরান উপকূলে।
গত তিন দিন ধরে জাহাজটি একই জায়গায় নোঙ্গর করে আছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। তারা জানাচ্ছে, জাহাজটি গদবজিরান শহর থেকে ৪ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশানের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘এমভি আব্দুল্লাহ যে জায়গায় ছিল গত তিন দিন ধরে সেখানেই আছে। আমরা আশা করছি এখান থেকেই তারা মালিকপক্ষের সাথে দেন-দরবার শুরু করবে।’
ফুরিয়ে আসছে খাবার; যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পরিবার
আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ।
জিম্মি হওয়ার দুই দিন পর্যন্ত জাহাজটির অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য পরিবারের কাছে জানানোর সুযোগ পেয়েছিল জিম্মি নাবিকরা। কিন্তু গত দু’দিন ধরে সে যোগাযোগও বন্ধ।
এ জাহাজে থাকা তিনজন জিম্মি নাগরিকের পরিবারের সাথে মঙ্গলবার কথা হয়। গত দু’দিনে কারো পরিবারের সাথে যোগাযোগ হয়নি তাদের।
সর্বশেষ শনিবার চিফ অফিসার ক্যাপ্টেন আতিকুল্লাহ খানের সাথে তার পরিবারের কথা হয়।
ক্যাপ্টেন আতিকুল্লাহ খানের মা শাহানুর বেগম জানান, ‘আমাদের সাথে শেষ যখন কথা হয়েছে তখন আমার ছেলে আমাকে বলেছে দিকে ওরা গায়ে হাত না দিলেও অনেক দুর্ব্যবহার করা শুরু করেছে।’
বিশেষ করে ভারতীয় নৌবাহিনীর হেলিকপ্টার টহল দেখার পর থেকে জলদস্যুদের আচরণে পরির্বতন হয়েছে বলেও জানাচ্ছিলেন শাহানুর বেগম।
ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর খাবার ও পানি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এর মধ্যে জিম্মি নাবিকদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে সশস্ত্র জলদস্যুরা।
সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার তৌফিকুল ইসলামের শ্যালক সিব্বির মাহমুদ জানান, ‘গত শনিবারের পর থেকে আমাদের সাথে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। এ নিয়ে পুরো পরিবার দুশ্চিন্তায় আছি।’
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজ। কয়েক দফায় দস্যুরা জাহাজে আসা-যাওয়া করছে। প্রায় সব সময় জাহাজে থাকছে ৩০-৪০ জন জলদস্যু। তারা নিয়মিত জাহাজের খাবার খাচ্ছে বলেও নাবিকরা তাদের পরিবারকে জানিয়েছে।
জিম্মি ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের বড় ভাই ওমর ফারুক জানান, সর্বশেষ তার ভাই যখন তাকে দু’দিন আগে তাকে ফোন দিয়েছিলেন তখন জানিয়েছিলেন জিম্মি আব্দুল্লাহর নাবিকদের সবচেয়ে বড় ভয় খাদ্য ও পানি সংকট।
ওমর ফারুক বলেন, ‘কারণ সোমালি জলদস্যুরা খাবার শুধু খাচ্ছে না। তারা প্রতিবেলায় খাবার নিয়ে সেগুলো আবার নষ্ট করছে। প্রতিবেলায় গড়ে ১০০ জনের খাবার নষ্ট হচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে খুব শিগগিরই জাহাজে খাদ্য ও পানি সংকট দেখা দিবে।’
উদ্ধারে আর্ন্তজাতিক অভিযান?
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এমভি আব্দুল্লাহ এবং জিম্মি নাবিকদের জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করতে সোমালি পুলিশ এবং আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশটির পান্টল্যান্ড অঞ্চলের পুলিশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় কমান্ডোরা জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনে অভিযান চালিয়ে ১৭ ক্রুকে উদ্ধারের পর এমভি আব্দুল্লাহতে অভিযানের এই পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সোমালিয়ার একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পান্টল্যান্ডের পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, এমভি আব্দুল্লাহকে দখল করে থাকা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর অভিযানের একটি পরিকল্পনা তারা জানতে পেরেছে। সে কারণে তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং অভিযানে অংশ নিতেও প্রস্তুত রয়েছে।
এর আগে রোববার এমভি আব্দুল্লাহ ছিনতাইয়ের সাথে অভিযুক্ত দু’জনকে আটকের কথাও জানায় পান্টল্যান্ড পুলিশ।
ভারত মহাসাগরে দস্যুদের কবলে থাকা জাহাজ ও নাবিকদের কোনো ধরনের ক্ষতি ছাড়া অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা যাবে?এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের স্পষ্ট জবাব- না। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে উদ্ধার অভিযানে গেলে প্রাণহানি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকবে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘মাল্টার জাহাজ রুয়েন তিন মাস আগে দস্যুদের কবলে পড়েছিল। সেই জাহাজের প্রেক্ষাপট আর বাংলাদেশের জাহাজের প্রেক্ষাপট এক না।’
তিনি মনে করেন, রুয়েনের মতো একই প্রক্রিয়ায় এমভি আব্দুল্লাহ উদ্ধার করা সম্ভব না। কেননা, বাংলাদেশী জাহাজটি কয়লাবাহী। উদ্ধার অভিযানের সময় গোলাগুলি হতে পারে। সেটি যদি হয় তাহলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে হবে বাংলাদেশকেই। কেননা কয়লাবাহী জাহাজ মেরিটাইম খাতে ঝুঁকিপূর্ণ কার্গো হিসেবে পরিচিত।
জিম্মি নাবিকদের পরিবারও এই ধরনের অভিযান না চালানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খানের মা বলেন, ‘আমরা কোনো যুদ্ধ করে সন্তান ফেরত চাই না। এমনিতেই টহলের হেলিকপ্টার দেখার পর থেকে দস্যুরা জিম্মিদের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। আমরা চাই মুক্তিপণের মাধ্যমে ওদের ফেরত আনা হোক।’
বাংলাদেশী জাহাজটির মালিকপক্ষও এমন অভিযানের পক্ষে না। আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের অভিযানের প্রস্তাব আসলে তারা নাকচ করবেন বলেও জানিয়েছে কেএসআরএম গ্রুপ।
কেএসআরএম’র মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জলদস্যুদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। অভিযান নয়, আমরা শান্তিপূর্ণ যেকোনো উপায়ে অক্ষত অবস্থায় নাবিকদের ফেরত আনতে চাই।’ সূত্র : বিবিসি
চাটগাঁ নিউজ/এসএ