সরোজ আহমেদ : এক সাথে দুই হাজার মুসল্লির ইফতার করার দৃশ্য বিরল। রমজানের প্রতি সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে ধনী-গরিবের বৈষম্যহীন এই দৃশ্যের দেখা মিলে।
ধর্মপ্রাণ রোজাদারেরা সারি সারি প্লেটে রাখা রকমারি ইফতারি সামনে নিয়ে বসে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। এই ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক ছাদের নিচে সমাবেত হন প্রতিদিন। ইফতারের আগ মুহূর্তে পুরো মসজিদে বিরাজ করে ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ। তবে হাজার হাজার রোজাদারের এসব ইফতারের যোগানদাতারা বরাবরই আড়ালে থাকেন। তাই কথিত আছে, গায়েবি সহায়তায় চলে এই আয়োজন।
চট্টগ্রামের প্রাচীন এ মসজিদে ইফতারের আয়োজন এক অন্যরকম সৌহার্দ্যের অবতারণা। এখানে চট্টগ্রামের নামিদামি বিত্তবান ব্যক্তিরাও ইফতার করতে আসেন। ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে রোজাদারদের সাথে ইফতার করে বিত্তবানরাও আনন্দ পান। এছাড়াও ইফতার নিতে মসজিদে আসেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকজনও।
রবিবার (১৭ মার্চ) বিকেলে নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে গিয়ে দেখা যায়, মসজিদের খোলা বারান্দায় রোজাদারদের বিশাল জমায়েত। হাজার হাজার মানুষ সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন। মসজিদের মেঝেতে প্রতিটি প্লেটে দেওয়া হচ্ছে আট রকমের ইফতার। এতে রয়েছে- চনা, মুড়ি, খেজুর, পিঁয়াজু, আলুর চপ, জিলাপি, অনথন, শরবত ইত্যাদি।
আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদের মুসল্লি পরিষদের সদস্যরা বলেন, অনেক লোক দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ইফতার করতে আসেন। বিশেষ করে শুক্রবারে অনেক জেলা-উপজেলা থেকেও এখানে ইফতার করতে আসেন। মসজিদের নির্ধারিত লোকজনের পক্ষে তাদের সবাইকে ইফতারের সার্বিক তদারকি করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই মুসল্লিদের পক্ষ থেকে আমরাও সহযোগিতা করে থাকি।
তারা বলেন, প্রতিদিন রমজানের তাৎপর্য নিয়ে আসরের নামাজের পর থেকে শুরু হয়ে ইফতারের আগ পর্যন্ত চলে আলোচনা। আর মোনাজাতের মাধ্যমেই আলোচনার সমাপ্তি হয়।
জানা গেছে, নগরের কাজীর দেউড়ির আবুল হোসেন বাবুর্চির নেতৃত্বে সাতজন সহকারী বাবুর্চি দ্রুত হাতে কাজ করে যাচ্ছেন। মসজিদের এক পাশে বিশাল রান্নাঘর সেখানে রোজ আবুল হোসেন বাবুর্চি রোজাদারদের ইফতার তৈরি করেন।
এতগুলো মানুষের ইফতার খুব যত্ন এবং দায়িত্বের সাথে তৈরি করা আবুল হোসেন বাবুর্চির সাথে কথা হলে তিনি বলেন, রমজান আসলেই এখানে কাজ করতে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। দীর্ঘদিন ধরে এ মসজিদের ইফতার রান্নার কাজ করছি। হাজার হাজার মানুষের ইফতার তৈরি করলেও এতটুকু ক্লান্তি লাগে না।
তিনি বলেন, রমজানের ইফতার সামগ্রীগুলো প্রতিদিন সকাল ছয়টা থেকে রান্না শুরু হয়ে একনাগাড়ে চলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। এভাবে বহু মানুষের রান্না একসাথে করে তাদের খাওয়াতে পারার আনন্দই আমার কাছে অনেক। পুরো রমজান মাস রোজাদারদের ইফতার রান্নার কাজে ব্যয় হয়। বছরের বাকি সময়ে বিয়ে, জিয়াফত ইত্যাদি অনুষ্ঠানে রান্নার কাজ করি। কিন্তু বছরের অন্য দিনগুলোর চেয়েও আমার কাছে রমজান মাসের এ কাজ মনকে বেশি আনন্দ দেয়।
কথা হয় ছেলেকে নিয়ে ইফতারের অপেক্ষায় থাকা ব্যবসায়ী শাহ আলমের সাথে। তিনি বলেন, গত বছর রমজানে ইফতার করার জন্য একা এসেছিলাম। এইবার ছেলেকে নিয়ে এসেছি। সুযোগ পেলেই মসজিদে ইফতার করার চেষ্টা করি। তবে এখানে এসে ইফতার করার আনন্দটা একটু বেশি। এতগুলো মানুষ সবাই একসাথে ইফতার করতে পারা এতে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। আর তারচেয়ে বড় কথা মসজিদে সবার সাথে ইফতার করার সওয়াবই আলাদা।
চন্দনাইশ থেকে সোহেল বন্ধুদেরকে নিয়ে টেরিবাজারে কেনাকাটা করতে এসেছিল। এরই মধ্যে ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসায় বন্ধুদেরকে নিয়ে মসজিদে চলে আসেন। কথা হয় আবির ও আবিরের বন্ধুদের সাথে।
তারা বলেন, এবারই প্রথম এ মসজিদে ইফতার করতে এসেছি। আগে কখনও আসা হয়নি। বড়জনদের মুখে শুনেছি এ মসজিদে একসাথে অনেক রোজাদারদের ইফতারের আয়োজন করা হয়। এখন তা নিজ চোখে দেখতে পেলাম! এতগুলো রোজাদার একসাথে ইফতার করবো এটা ভেবেও ভালো লাগা কাজ করছে।
কথা হয় আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিবের একান্ত সহকারী মো. হাসান মুরাদের সাথে। তিনি বলেন, এখানে অনেকেই ইফতার সামগ্রীর জন্য আর্থিক সহায়তা করেন। কিন্তু কেউ তাদের নাম প্রকাশ করেন না। রমজানের প্রথম দিকে দেড় থেকে দুই হাজার মানুষের ইফতারের আয়োজন করা হয়। পরে ক্রমাক্রমে দুই থেকে চার হাজার পর্যন্ত রোজাদারের সমাগম ঘটে। তবে কোনো সময়েই ইফতারে টান পড়ে না।
তিনি বলেন, আজ দুই হাজার রোজাদারের ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। আর ইফতার সামগ্রী হিসেবে রয়েছে মুড়ি, চনা, খেজুর, পিঁয়াজু, আলুর চপ, জিলাপি, অনথন ও শরবত ইত্যাদি।
তিনি আরও জানান, এখানে ইফতার করতে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনই নন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোকজনও আসেন। তারাও সওয়াবের আশায় ইফতারি সংগ্রহ করে নিয়ে যান। ইফতারি সবার জন্যই উন্মুক্ত। কারো জন্য বাধ্যবাধকতা নেই। আর এখানে যে কেউ ইফতার সামগ্রীর জন্য আর্থিক সহযোগিতাও করতে পারেন।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ