সেবা ব্যাহত— জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্বে না ফিরলে বরখাস্ত

চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশের অধিকাংশ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর ও উপজেলা চেয়ারম্যানরা চলে গেছেন আত্মগোপনে। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। সরকার পতনের দিন থেকে বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধির মোবাইল ফোন বন্ধ। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন উত্তরাধিকার সনদ, জন্মসনদ, চারিত্রিক সনদ, ট্রেড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা নিতে আসা নাগরিকরা। থমকে গেছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজও। ফলে চলমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতি এবং প্যানেল মেয়রদের উপস্থিতিও নিশ্চিত করতে না পারায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দায়িত্বে না ফিরলে আইন অনুযায়ী তাদের বরখাস্ত করে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। এখন প্যানেল মেয়র মনোনীত করে তাদের দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সেবা কোনোভাবেই বন্ধ রাখা ঠিক হবে না। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জোনাল অফিসের মাধ্যমে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে।

শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপরই আওয়ামী লীগের বিদায়ী মন্ত্রী, এমপি ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা গা-ঢাকা দেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র, প্যানেল মেয়রসহ ১৭২ জন কাউন্সিলরের মধ্যে মাত্র ১৮ জন বিএনপিপন্থি। ওই ১৮ জন ছাড়া অন্যরা কেউই ৫ আগস্টের পর থেকে অফিস করছেন না। তারা কোথায় আছেন তাও জানেন না সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। শুধু সিটি করপোরেশন নয়, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও মেম্বরদের বেশিরভাগই আত্মগোপনে।

ইউনিয়ন পরিষদ আইন-২০০৯ এ উল্লেখ আছে, কোনো ইউপি সদস্য পরপর তিন কার্যকরী মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ বাতিল হবে এবং সুনির্দিষ্ট কারণে বছরে সর্বোচ্চ তিন মাস ছুটি নিতে পারবেন। এ ছাড়া জনপ্রতিনিধিদের দেশের বাইরে বহির্গমন করতে হলে তাকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বাধ্যতামূলক অনুমতি নিতে হবে।

সরকারের পতনের পর থেকে আর কার্যালয়ে আসছেন না চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ও অধিকাংশ ওয়ার্ড কাউন্সিলর। গা-ঢাকা দিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও আওয়ামী লীগপন্থি কাউন্সিলররা। ফলে এ দুই সিটির নাগরিক সেবা কার্যক্রমও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়রদের অনুপস্থিতিতে আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন সিটি করপোরেশনগুলোর পদস্থ কর্মকর্তারা। কারণ সিটি করপোরেশনের অর্থ-সংক্রান্ত সব কাজ মেয়রের ওপর নির্ভরশীল। চেক স্বাক্ষর ছাড়াও কেনাকাটার ব্যাপারে মেয়রের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। মেয়র না থাকায় জরুরি কেনাকাটাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ফজলে নূর তাপস সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামও অফিসে আসছেন না। ডিএনসিসিতে শুধু বিএনপিপন্থি চারজন কাউন্সিলর করপোরেশনে যাতায়াত করছেন। ফলে দুই সিটি করপোরেশনের আর্থিক কর্মকাণ্ড, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ অধিকাংশ কার্যক্রমই বন্ধ রয়েছে। অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে অল্প কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে কোনোমতে চলছে শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও মশক নিধন কার্যক্রম।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, মেয়র ও কাউন্সিলর অফিসগুলোর কার্যক্রম চালু না থাকায় আর্থিক কার্যক্রম ও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সেবা বন্ধ আছে। এদিকে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, কয়েকদিন ধরে মেয়র-কাউন্সিলর অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। তবে গুরুত্ব অনুসারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশক নিধন ও সড়কবাতি সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে।

গতকাল বুধবার স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়েছে, সম্প্রতি উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের অনেক মেয়র ধারাবাহিকভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। যোগাযোগ করেও তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়ররাও কর্মস্থলে ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত রয়েছেন এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিটি করপোরেশনের অনেক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে এবং জনসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। যেসব সিটি করপোরেশনে এরূপ পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে পুনরাদেশ না পাওয়া পর্যন্ত সাময়িকভাবে পূর্ণ আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করা হলো।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, মেয়র ও কাউন্সিলররা অনুপস্থিত থাকায় নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরবাসী। এ স্থবিরতা কাটাতে মন্ত্রণালয়ের উচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের দ্রুত অফিস করার নির্দেশ দেওয়া। মেয়র অফিস না করলে প্যানেল মেয়রদের মধ্য থেকে কাউকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র করা যেতে পারে। ভারপ্রাপ্ত মেয়র করার মতো কেউ না থাকলে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসক নিয়োগ করা দরকার। নাগরিক সেবা দেওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, মেয়র ও কাউন্সিলরদের নির্দিষ্ট সময় দিয়ে কাজে যোগদানের জন্য নির্দেশ দিতে হবে। সে সময়ের মধ্যে না এলে সরকার তাদের পদগুলো শূন্য ঘোষণা করতে পারবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিদায়ী সরকারের আমলে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও তো সঠিকভাবে হয়নি। তাই বর্তমান সরকারের উচিত হবে যেসব জনপ্রতিনিধি পালিয়ে গেছেন বা আত্মগোপনে আছেন তারা দ্রুত দায়িত্ব পালনে ফিরে না এলে তাদের বরখাস্ত করে শূন্যপদে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। তা হলে নাগরিক সেবা ব্যাহত হবে না।

স্থানীয় সরকার বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আত্মগোপনে থাকা জনপ্রতিনিধিরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দায়িত্বে না ফিরলে আইন অনুযায়ী তাদের বরখাস্ত করে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে মেয়র ও কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতির ছুটি সংক্রান্ত ১৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার কোনো মেয়রকে এবং মেয়র কোনো কাউন্সিলরকে এক বছরে সর্বোচ্চ তিন মাস ছুটি মঞ্জুর করতে পারবে। কোনো কাউন্সিলর ছুটিতে থাকলে বা অন্য কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকলে ওই ছুটি বা অনুপস্থিতকালের জন্য মেয়র পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলরকে দায়িত্ব দিতে পারবেন।

চাটগাঁ নিউজ/এসএ

Scroll to Top