উজ্জ্বল দত্ত : দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি নিয়ন্ত্রণে একদিকে চলছে জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার টাস্কফোর্সের নিয়মিত অভিযান। আবার অন্যদিকে সরবরাহ চেইন ঠিক রাখতে পেঁয়াজ, আলু কিংবা চালের পর্যাপ্ত আমদানিও আসছে। কিন্তু কিছুতেই যেন লাগাম টানা যাচ্ছেনা এই প্রধান তিন পণ্যের আকাশছোঁয়া দামের।
অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বেড়েই চলেছে এই পণ্য তিনটির দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে আলু,পেঁয়াজ ও চালের আরেক দফা মূল্য বেড়ে গেছে। বাস্তব অবস্থা এমন, ‘সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় যেন টাস্কফোর্স’।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের আমদানিকারকরা পাকিস্তান, চীন, মিশর, মিয়ানমার, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কম দামি পেঁয়াজ আমদানি করেছেন। চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিশর, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও চীনের ৪৫৯ টন পেঁয়াজের চালান এসেছে। তাছাড়া গত অক্টোবরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৫৬২ টন।
খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের বড় বিপণিকেন্দ্র হামিদ উল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, পেঁয়াজ আমদানিতে সরকার শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। ভারতীয় পেঁয়াজ মান ও সাইজ ভেদে ৮৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। মিশরীয় পেঁয়াজ ৬৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা থেকে ১১৫ টাকা দরে।
কিন্তু এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৪০ টাকায়। আমদানিকৃত পেঁয়াজ খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা কেজি। গত সপ্তাহে বার্মাইয়া পেঁয়াজ ঢাকার বাজারে ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
তবে ভারতীয় বা দেশি পেঁয়াজ নিয়ে কথা না উঠলেও মিশর,মায়ানমার,তুরস্ক, পাকিস্তানি বা চায়নার কম দামি পেঁয়াজ এমন উর্ধগতি কেন- সেই প্রশ্ন ক্রেতাদের।
অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটের কারণে শুল্ক কর প্রত্যাহার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু আমদানিকারকরা অতিরিক্ত দামে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের পাইকারদের কাছে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। এ কারণে পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম কমছে না।
একই অবস্থা আলুতেও । আলু আমদানিতে শুল্ক-কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ভারত থেকে আসতে শুরু করেছে আমদানিকৃত আলুর ট্রাক।
হিলি স্থল বন্দর শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার (৭ নভেম্বর) ভারত থেকে ১ হাজার ৮১৮ টন আলু বাংলাদেশে ঢুকেছে। এটি হিলি স্থলবন্দর দিয়ে এক দিনে আলু আমদানির নতুন রেকর্ড। আমদানিকৃত আলুগুলোর মধ্যে আছে গ্রানুলা (সাদা) ও কার্ডিনাল (লাল) জাতের আলু ।
কিন্তু তা সত্ত্বেও আলুর কেজি খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭২ টাকায়। অথচ গত সপ্তাহেও আলুর দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এই পণ্যটির দামও বেড়ে চলেছে ধারাবাহিক ভাবে।
রিয়াজউদ্দিন বাজারের আলুর আড়তদার শামীম হোসেন বলেন, শুধু সিন্ডিকেট নয়, সিন্ডিকেট ছাড়াও কোল্ড স্টোরেজে আলুর দাম বাড়ছে। আবার ক্ষেতের একটি বিষয় রয়েছে। সরকার থেকে বিলম্বে বীজ পাওয়ায় পিছিয়ে গেছে আগাম আলুর আবাদ। একদিকে দেরিতে আলু চাষ তার সাথে যুক্ত হয়েছে বেশি লাভের আশায় চাষীদের আগাম আলু তোলা। আগাম আলু তুলে ফেলার কারণে আকারে ছোট আলু আসছে বাজারে। কিন্তু এই ছোট আলু সঠিক সময়ে তোলা হলে আরো বড় হতো । ফলনের হার বেড়ে যেত। ভারতের সাদা আলুর চাহিদা থাকলেও লাল আলুর চাহিদা কম।
নগরীর বিভিন্ন বাজারে এখন প্রতি কেজি মোটা চাল (গুটিস্বর্ণা ও চায়না ইরি) বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৬ টাকায়। মাঝারি চালের (বিআর-২৮ ও পাইজাম) কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং চিকন চালের (মিনিকেট ও নাজিরশাইল) কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাহাড়তলী ও চাক্তাই পাইকারি চালের বাজারে মিল সব ধরনের চালের দাম বাড়তি। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট মো: আল আমিন হোসেন বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি বাজার মনিটরিং জোরদার করেছে। শুধু জেলা পর্যায়ে নয়, উপজেলা পর্যায়েও টাস্কফোর্স কমিটি ব্যাপকভাবে বাজার মনিটরিং করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করছে জেলা প্রশাসন।
বর্তমান সরকারের নির্দেশনা-যে কোনো মূল্যে সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা। টাস্কফোর্স প্রতিদিনই নগরীর বিভিন্ন বাজারে মনিটরিং করছে। আগামীতে টাস্কফোর্স আরো কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করবে।
এই ব্যাপারে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসাইন বলেন, টাস্কফোর্সের কাজ লোক দেখানো। সরকার বিষয়টি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে রুটিন ওয়ার্ক করা হচ্ছে। সপ্তাহ ধরে তো অভিযানও চলছে না। অভিযান চললেও নামকা ওয়াস্তে জরিমানা আদায়ে কাজ শেষ।
পাহাড়তলী, খাতুনগঞ্জে যদি কোন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, সেটা কি যথেষ্ট? এই জরিমানার টাকা তো ব্যবসায়ীরা দৈনিক চা-নাস্তার পেছনেই ব্যয় করে থাকেন। ব্যবসায়ীরা এখন বেপরোয়া। তাদের টিকিও কেউ ধরতে পারছে না।
চাটগাঁ নিউজ/উজ্জ্বল/জেএইচ