চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের খোঁজে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই ও সিঙ্গাপুরে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে এ বছরের এপ্রিলে এসব এমএলএআর পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনোটির জবাব পাওয়া যায়নি। দুদক বলছে, তারা সব দেশের সঙ্গে বিভিন্ন চ্যানেলে যোগাযোগ রেখেছে।
দুদকের এমএলআরের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অবশ্য যুক্তরাজ্য পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। তারা সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় ৭৩.১৫ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১০২৫ কোটি টাকা সম্পদ ও ২৫ কোটি টাকা ক্রোক বা ফ্রিজ করেছে। যদিও দুদকের এমএলএআরের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্য সরকার থেকে সুনির্দিষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে সিঙ্গাপুর, দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফরমাল ও ইনফরমাল চ্যানেলে যোগাযোগ হলেও ফলপ্রসূ ফলাফল এখনো আসেনি বলে জানা গেছে। এসব দেশে আওয়ামী নেতা সাইফুজ্জামানের ৬ শতাধিক অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটসহ কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট আমরা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে পাঠিয়েছি। আমরা ভাগ্যবান যে যুক্তরাজ্য প্রথম এতে সাড়া দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমরা যেসব সম্পদ জব্দ করব, তা আনতে পারব কি না, এটার মধ্যে একটা সূক্ষ রেখা রয়ে গেছে। সেই অংশটুকু হচ্ছে, আমরা যে দাবিটা করছি, সে দাবিটা আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই দাবির সমর্থনে আমাদের আদালতের যেমন আদেশ থাকবে, তেমনি ব্রিটেনের আদালত যদি আদেশ দেয়, তারপরেই আমরা সেটা আমাদের কাছে ফেরত আনতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে আমরা আমাদের যত টাকা পাচার হয়েছে, সব টাকা আমরা ফেরত আনতে পারবো, এটা আমি ঠিক সেভাবে বলতে পারবো না। আমরা যতটুকু প্রমাণ করতে সক্ষম হবো, ততটুকু আমরা আশা করি ফেরত আনতে পারবো। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা একটি জটিল প্রক্রিয়া। তবে আমি চেষ্টা করছি।’
নাম প্রকাশ না করে দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, চার দেশে এমএলএআর পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত সরাসরি জবাব পাওয়া যায়নি। তবে দুদক সব দেশের সঙ্গে বিভিন্ন চ্যানেলে যোগাযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি তথ্য লেনদেন হয়েছে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে। সিঙ্গাপুর, দুবাই ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফরমাল ও ইনফরমাল চ্যানেলে যোগাযোগ রয়েছে। ’
গত ১১ জুন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন বেশকিছু সম্পত্তি জব্দ করেছে দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)। ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিটের (আই-ইউনিট) বরাতে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল-জাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের আইনি অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এই পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাজ্য। মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ও আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বেশকিছু সম্পত্তির বিরুদ্ধে ফ্রিজিং অর্ডার (সম্পদ জব্দের আদেশ) জারি করা হয়েছে। এর অর্থ হলো সাইফুজ্জামান চৌধুরী কার্যকরভাবে সেইসব সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না।
এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বৈশ্বিক সম্পত্তি নিয়ে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনের অনুযায়ী, বিদেশে তার আনুমানিক ৫০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পত্তি রয়েছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ কিনেছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী, যার মধ্যে শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যেই তার ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে।
সাইফুজ্জামানের যত সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ
সাবেক প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রী রুকমীলার নামে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি সহ অন্যান্য দেশেও বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/জমিসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করার আদেশ দিয়েছে বাংলাদেশের আদালত।
২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবরে দেওয়া আদেশ সূত্রে জানা যায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী, এর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে তার এবং তার স্ত্রী রুকমীলা জামানসহ পরিবারের সদস্যদের নামে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি সহ অন্যান্য দেশেও বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/জমিসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। যা ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ক্রয় করা হয়েছে। সে সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান/পরিচালক ছিলেন।
অন্যদিকে, তার স্ত্রী রুকমীলা জামান গত ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান ছিলেন। এই ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণ করেছেন বলেও জানা যায়। বিদেশি এসব সম্পদ অর্জনের বিষয়টি বাংলাদেশের আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি, কিংবা সাইফুজ্জামান চৌধুরী তার নির্বাচনী হলফনামায় বিদেশে সম্পদ অর্জনের তথ্য দেননি।
অন্যদিকে, গত ৫ মার্চ অপর এক আদেশে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নামে থাকা ৩৯টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের (অবরুদ্ধ) আদেশ দেয় আদালত। এছাড়া, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাইফুজ্জামানের ১০২ কোটি টাকার শেয়ার ও ৯৫৭ বিঘা জমি জব্দেরও আদেশ দেয় আদালত। আর ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। যদিও বিভিন্ন সূত্র বলছে, তারা অনেক আগেই দেশত্যাগ করেছেন।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ