চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া এবং সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
রোববার (১৮ আগস্ট) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে এক দফা দাবির মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপরই তার সরকারের সময়ের মন্ত্রী-এমপি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি-অর্থপাচারের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দুদক সচিব বলেন, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া ও সাবেক ডিবি প্রধান হারুনের বিরুদ্ধে কমিশনের অনুমোদনক্রমে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনেকদিন আগে থেকেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান ছিল। যাচাই-বাছাইয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী
সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছর ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল থেকে তার মালিকানাধীন কোম্পানি প্রায় ২০ কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড (২৭৭০ কোটি টাকা) মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি কিনে যুক্তরাজ্যে রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। যুক্তরাজ্যের কোম্পানি হাউস করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে এ পরিসংখ্যান পেয়েছে বার্তা সংস্থা ব্লুমবার্গ। ওই প্রতিবেদনের বরাতে দুদকে অভিযোগ দাখিল এবং পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে রিট হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দুদক থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
দুদকের অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচারের টাকায় গড়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কিনেছেন ফ্ল্যাট। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রে তিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ৯ ফ্ল্যাট।
সাইফুজ্জামান ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থপাচার শুরু করেন। দেশটিতে নাহার ম্যানেজমেন্ট ইনকরপোরেটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন তিনি। ২০০৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময় এই প্রতিষ্ঠানের নামে ৯টি প্লট বা ফ্ল্যাট কেনেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৬ ফ্ল্যাট বেচাকেনা
সাইফুজ্জামান সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবসা করার জন্য র্যাপিড র্যাপ্টর এফজিই নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। পরের বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি ভবন নির্মাণ ও নির্মাণসামগ্রী বিক্রির জন্য জেবা ট্রেডিং এফজিই নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এ ছাড়া গত বছরের শেষদিকে তার স্ত্রী রুখমিলা জামান চৌধুরীর নামে আল-বারশা সাউথ-থার্ড এলাকায় কিউ গার্ডেন্স বুটিক রেসিডেন্স-ব্লক বিতে দুটি ফ্ল্যাট কেনা হয়। এর মধ্যে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ১১ লাখ ২৫ হাজার ৩০০ দিরহামে একটি এবং ৩০ নভেম্বর ১১ লাখ ২৫ হাজার ৬৯ দিরহামে অপর ফ্ল্যাটটি কেনা হয়। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে দুবাই ইসলামী ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এ ছাড়া দেশটির ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংকে একটি দিরহাম ও একটি ডলার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আর দেশটিতে কার্যরত জনতা ব্যাংকে রয়েছে একটি দিরহাম অ্যাকাউন্ট। সবমিলিয়ে এসব অ্যাকাউন্টে ৩৯ হাজার ৫৮৩ দিরহাম এবং ৬ হাজার ৬৭০ ডলার জমা আছে।
লন্ডনে ৮ কোম্পানি
লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ৮টি কোম্পানি রয়েছে, যার বাজারমূল্য ২০ কোটি ৩১ লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। দেশটিতে তার স্ত্রী রুখমিলা জামান ও মেয়ে জেবা জামানের নামেও কোম্পানি রয়েছে। এ ছাড়া পারিবারিক মালিকানায় থাকা ব্যবসায়িক গ্রুপ আরামিটের নামে একটি কোম্পানি রয়েছে বলে জানা যায়।
সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া
গত ২৭ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের দাবি জানিয়ে দুদকে আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। ওই আবেদনসহ আরও বেশকিছু অভিযোগ জমা হয় দুদকে। যা যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, আছাদুজ্জামান নিজ নামে, স্ত্রী আফরোজা জামান ও তিন সন্তান আসিফ শাহাদাত, আয়েশা সিদ্দিকা, আসিফ মাহাদীন এবং শ্যালক-শ্যালিকা, ভাগনেসহ আরও অনেকের নামে-বেনামে হাজার-হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। এর মধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভাঙ্গা হাইওয়ের পাশে এবং রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকাসহ আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, জোয়ার সাহারা, সাভার ও পূর্বাচলে জমি, প্লট ও বাড়ির ছড়াছড়ি।
সম্পদের মধ্যে আছাদুজ্জামান মিয়ার নামে সাড়ে ৭ কাঠা, আফতাবনগরে ৬ কাঠা, পুলিশ হাউজিংয়ে ৬ দশমিক ৯ কাঠা, পূর্বাচল ১৪ নম্বর সেক্টরে ৩ কাঠা, পূর্বাচল ৮ নম্বর সেক্টরের ১০৮ নম্বর রোডে ৫ কাঠা ও সাভারে ২ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া, আছাদুজ্জামানের নামে রয়েছে ৩২২ শতাংশ জমি, ৬৮ ও ২১৫ শতাংশ জমি, ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ৮ শতাংশ জমি আছে। ফরিদপুরের গ্রামে আছে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি।
তার বড় ছেলে আসিফ শাহাদাতের বয়স ৩৫ বছর। যিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার বয়স ৩১ বছর। ২১ বছর বয়সী ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীন আমেরিকায় পড়াশুনা করেন। এই তিন ভাই-বোন অল্প বয়সেই শতকোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামান পুরোদস্তুর গৃহিনী। তার নিজস্ব কোনো আয়ের সংস্থান নেই। তবে সম্পদে পিছিয়ে নেই। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একাধিক দামি ফ্ল্যাট, প্লট, ৫০ কোটি টাকা দামের আলিশান বাড়ি এবং গাজীপুরের কালীগঞ্জে ও নারায়ণগঞ্জে কোটি-কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে তার নামে।
স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে রয়েছে আবাসিক এলাকায় ১০ কাঠা জমির ওপর ছয়তলা বিশিষ্ট আলিশান বিশাল বাড়ি, যার বাজার মূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া তার নামে রাজধানীর ১৩/এ, ইস্কাটন গার্ডেন ও ধানমন্ডির ১২/এ সড়কের ৬৯ নম্বর বাড়িতে (বি/২/৫) ফ্ল্যাট আছে।
অভিজাত ধানমন্ডি-১২/এ-তে, ইস্কাটনে আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ফ্ল্যাট রয়েছে। পূর্বাচলে ১০ কাঠা প্লট, মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় প্লট রয়েছে তার।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, আছাদুজ্জামানের শ্যালক-শ্যালিকার নামেও সম্পত্তির ছড়াছড়ি। তাদের নামেও কোটি কোটি টাকার জমি রয়েছে। শ্যালিকা ফাতেমাতুজ্জোহরার নামে ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট, খুলনায় বাড়ি এবং মোহাম্মদপুরে একাধিক জমি রয়েছে। পরিবহন ব্যবসাও রয়েছে তার।
আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর সৎ ভাই হারিচুর রহমান সোহানের নামেও পরিবহন ব্যবসা আছে। এ ছাড়া, তিনি নিজেকে পিওর গোল্ড লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়েছেন। শ্যালকের এসব ব্যবসায় আছাদুজ্জামানই বিনিয়োগকারী বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।
সোহানের নামে রাজধানীর অভিজাত বেইলি রোড, শাহজাহানপুরে ফ্ল্যাট রয়েছে। বনশ্রী ও আফতাবনগরে একাধিক প্লট রয়েছে। এর মধ্যে বনশ্রীর একটি প্লটে বাড়ির নির্মাণকাজও চলছে। আছাদুজ্জামান মিয়ার অবৈধ টাকা দিয়ে এসব সম্পদ গড়া হয়েছে।
আলোচিত ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও সাবেক ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ কিশোরগঞ্জে নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নামে বিলাসবহুল প্রমোদাগার। জেলার মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে ৪০ একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে রিসোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। রিসোর্টটির প্রিমিয়াম স্যুটের প্রতিদিনের ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন ডিলাক্স রুমের ভাড়া প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা। রিসোর্টটিতে শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে ধারণা স্থানীয়দের।
২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রিসোর্টটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। পুলিশের আলোচিত-সমালোচিত কর্মকর্তা হারুনের প্রতিষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার ছোট ভাই ডা. শাহরিয়ার। তিনি হলি ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। রিসোর্টটিতে হারুনের পরিবারের ৫ থেকে ৭ একর জায়গা রয়েছে। বাকি অন্তত ৩৫ একর জায়গা ছিল অন্যদের। অন্য জমির মালিকদের দাম দেবেন বলে হারুন রিসোর্টের জন্য জায়গা দখলে নেন। তবে কেউই জমির দাম পুরোটা পাননি। জায়গার দাম না পাওয়ায় এখনো অন্তত ১০ থেকে ১২ জন তাদের জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি। তাদেরই একজন মিঠামইন সদর ইউনিয়নের গিরীশপুর গ্রামের দিলীপ বণিক। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে রিসোর্টটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন হারুন। লেখাপড়া শেষে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে চাকরি পান। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার এসে তার পদায়ন আটকে দেয়। এরপর ওয়ান ইলেভেনের সময় হারুনের চাকরি স্থায়ী হয়। মূলত গাজীপুরের এসপি থাকাকালীন কপাল খুলে যায় হারুনের।
গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের এসপি থাকার সময় থেকেই হারুন তার পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে বাড়ির পাশের হাওড়ে জমি কিনতে শুরু করেন। নামে-বেনামে তার কমপক্ষে ১০০ একর জমি রয়েছে। সেই সঙ্গে শতাধিক একর অন্যের জমিও দখল করেছেন। এমনকি দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রেও হারুনের শত শত কোটি টাকার সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ