চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক: সাংবাদিকতা পেশায় ‘রাজনৈতিক দলবাজি’ বন্ধ করা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। তিনি বলেন, পেশার জন্য হলেও ‘রাজনৈতিক দলবাজি’ বন্ধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাংবাদিকতা এবং দলীয় রাজনীতির আদর্শ থেকে খবর সেন্সর করা অথবা বিকৃত করা এগুলো সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করে। আমরা আগেও এ নজির দেখেছি।
আজ রবিবার (৫ জানুয়ারি) দুপুরে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রাম বিভাগের সাংবাদিকদের সাথে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে সাংবাদিকদের স্বার্থ-সুরক্ষার বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা।
সভায় কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ আরো বলেন— নীতিগতভাবে বা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য করা হয়েছে সাংবাদিকদের সাথে, রাজনৈতিক কারণে বৈষম্যের শিকার যারা হয়েছেন ব্যক্তি, সাংবাদিকদের ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটা আমাদেরকে বিবেচনায় নিতে হবে। একইভাবে হয়রানিমূলক মামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, জেল খেটেছেন দিনের পর দিন কাজ করতে পারেননি তাদের মামলা প্রত্যাহারের বিষয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বলা দরকার। আর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষতিপূরণের দাবিটাও যৌক্তিক এবং ন্যায্য।
সাংবাদিকদের দলীয় সক্রিয়তা, ফ্যাসিবাদে সহযোগিতার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আপনাদের (সাংবাদিক) বক্তব্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা রাজনৈতিক সক্রিয়তা, দলীয় সক্রিয়তা, ফ্যাসিবাদের সহযোগিতা। যারা ফ্যাসিবাদের সহযোগিতা করেছেন তাদের বিচারের প্রশ্ন। তাদের যারা উস্কানি দিয়েছেন তাদের বিচারের প্রশ্ন। সমস্যা হলো আমরা কোনো তদন্ত সংস্থা না। অপরাধগুলোর তদন্ত আমরা করতে পারবো না। তবে আমরা এটা বলতে পারি, যারা উস্কানিদাতা তাদের উস্কানির তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব প্রসঙ্গেও সভায় কথা বলেছেন কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ।
তিনি বলেন, প্রেসক্লাবের প্রশ্নটাও কিভাবে সমাধান করা যায় আমাদের ভাবতে হবে। বিশেষ করে এই প্রেসক্লাব একেবারেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এটি সদস্যদের ক্লাব। সদস্যরা যখন একটি সমিতি করেন সেসময় সমিতির সংবিধান করে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এরপর তারা রেজিস্ট্রেশন নেন। সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা একটা আলাদা চেইন। সেটার সাথে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কিংবা সংবাদপত্রকে শক্তিশালী করার সম্পর্ক সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। এই সমস্যার সমাধান আমাদের জানা নেই।
তিনি আরো বলেন— এমনও উপজেলা আছে যেখানে চারটা প্রেসক্লাব। এটি আসলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। প্রেসক্লাব করলে হয়তো কিছু সুবিধা পাওয়া যায়! প্রেসক্লাবের নেতা হলে মনে হয় একটু আলাদা মর্যাদা, একটু আলাদা কোনো আর্থিক ব্যাপার থাকতে পারে। সেই কারণে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আমরা বলতে পারি এটা একটা সমস্যা এটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার সমাধান কি হতে পারে।
সম্পাদকদের জন্য নীতিমালা হওয়া দরকার জানিয়ে কমিশন প্রধান বলেন— আমরা সম্পাদক পরিষদকে বলেছি, আসলে একটা জাতীয় নীতিমালা হওয়া দরকার। আপনারা একটা মান নির্ধারণ করেন যে এই ন্যূনতম মান আমাদের মেনে চলা দরকার। সেটা আশা করছি সম্পাদক পরিষদ সেই উদ্যোগটা নেবেন।
পত্রিকা প্রকাশক এবং সম্পাদকদের যোগ্যতা প্রসঙ্গে কামাল আহমেদ বলেন, পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে যোগ্যতার প্রশ্ন, পেশাদার সাংবাদিকের সম্পাদক হওয়ার প্রশ্ন—এগুলো কিন্তু নীতিমালায় আছে। কিন্তু আপনারাই বলছেন, উত্তরাধিকার সূত্র ভাই অথবা সম্পাদক বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেটা আবার সরকার গ্রহণ করছে। কারণ হতে পারে রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা অন্য কিছু।’
রাজধানীর দুটো সংবাদপত্র হকার্স সমিতির সংবাদপত্র বিক্রির পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, হকার্সদের পত্রিকা বিক্রির হিসেবের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। ঢাকা শহর থেকে ৩০২টি পত্রিকা মিডিয়া লিস্টে আছে, সারা দেশে ৫৯২টির মতো পত্রিকা আছে। আমরা দেখেছি হকারদের তালিকায় ৪৬টি কাগজ তারা লেনদেন করে। বাকি কাগজগুলোর কোনো পেপার (নথি) নেই। কেউ নেয় না ওই কাগজ। তাহলে এটা সরকারের মিডিয়া লিস্টিং এর মধ্যে ঢুকলো কি করে? এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
ডিএফপির কর্তৃক পত্রিকার প্রচারসংখ্যার অবাস্তব তথ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একইভাবে পত্রিকার প্রচারসংখ্যার দিকে থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের একার নামেই চারটি পত্রিকার ডিক্লারেশন ছিল। একটি পত্রিকার সার্কুলেশন যেটা ৬ হাজারেরও কম সেটাকে তিনি ২ লাখ ৯৯ হাজার দেখিয়েছেন, দেখাতে বাধ্য করেছেন। এখন তো হিসেবও বেরিয়েছে ২৯৬ কোটি টাকা ওনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন করা হয়েছে। সর্বাধিক প্রচারিত যে দাবি করা হয়, হকারের বেচা-বিক্রি হিসেবে সেটা ঠিক না।’
একই ব্যক্তি একাধিক শ্রেণির সংবাদপত্রের মালিক হতে পারবে না—সাংবাদিকদের এমন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, এটা কিন্তু অনেক দেশেই নাই। এমনকি আমেরিকাতেও একটা টেলিভিশন কোম্পানির মালিক একটা পত্রিকার মালিক হতে পারেন না। আমাদের এখানে একই হাউসে একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবার একই হাউসে টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন এবং বাংলা-ইংরেজি সংবাদপত্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একই হাউস থেকে একাধিক বাংলা পত্রিকা বের হচ্ছে। তাইলে পাঠক কি পাচ্ছে? এখানে কোনো বৈচিত্র্য থাকছে না। যেখান থেকে যে কেউ পত্রিকা বের করছে। এটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।’
‘বাংলাদেশে ৪৬টি টেলিভিশন চলার মতো বাজার নেই। কিন্তু ৪৬টি টেলিভিশনকে সরকার অনুমতি দিয়েছে। এটাতো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই টেলিভিশন কেন্দ্রগুলো যেহেতু বাজার নেই সেহেতু তারা আয়ও করতে পারে না। আবার নিয়োগ দেয় বিনা বেতনে, কার্ডের ব্যবসায় চলে যায়। এগুলো একটা দুষ্ট চক্র তৈরি হয়েছে। এগুলো ভেঙে একটা শৃঙ্খলা আনতে হবে।’
ওয়েজবোর্ডের বদলে সাংবাদিকদের একটা ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করার প্রস্তাবের বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, সেটা একটা ভাল সমাধান হতে পারে যে ন্যূনতম বেতন সারাদেশে সাংবাদিকদের জন্য থাকবে। যে শহরে খরচ বেশি, বিশেষ করে ঢাকায়—আলাদা করে একটা ভাতা বা বাড়তি বেতন দিতে হবে। আমরা আশা করছি এই ধরনের সমাধানগুলো আমরা আপনাদের কাছ থেকেই পাবো। সেটার ভিত্তিতেই আমরা সুপারিশমালা তৈরি করবো। বাস্তবায়ন সরকার করবে, সেটি আমাদের হাতে নয়। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও তাদের সুপারিশ লিখিতভাবে চেয়েছি।
গণমাধ্যম সংস্কার সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, শামসুল হক জাহিদ, আখতার হোসেন খান এবং বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রকাশক, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী।
চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ