চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : ফেসবুকে নীতিকথার ফুলঝুড়ি ছড়ালেও বাস্তব জীবনটা তার অনিয়ম-দুর্নীতি ও দালালিতে পরিপূর্ণ। তার ফেসবুক টাইমলাইন জুড়ে মিডিয়া ও মিডিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একের পর এক কুৎসা রটিয়ে নিজেকে ধোঁয়া তুলসিপাতা হিসেবে জাহির করেন। অথচ চাটগাঁ নিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তার নানা অপকর্মের সাতকাহন। বলছিলাম সময় টিভির লন্ডন প্রতিনিধি শোয়েব কবিরের কথা। যিনি আবার স্বঘোষিত মিডিয়া মাফিয়া হিসেবে পরিচিত!
কিন্তু দেশের ব্যাপক জনপ্রিয় অনলাইন চ্যানেল সিপ্লাস টিভির জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এবার সিপ্লাস টিভির এডিটর ইন চীফ আলমগরীর অপুর বিরুদ্ধে ওঠেপড়ে লেগেছেন। তার ফেসবুকে সিপ্লাস টিভিকে নিয়ে ছড়াচ্ছেন নানা অপতথ্য। যা সাংবাদিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অন্যতম সুবিধাভোগী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত এই শোয়েব কবির। তিনি সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের তোষামোদী করে একে একে ভাগিয়ে নেন ৭টি পত্রিকার নিবন্ধন। শুধু তাই নয়, মোটা অংকের বিনিময়ে বহু অখ্যাত পত্রিকা/অনলাইনের নিবন্ধনও পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি পোর্টালের সম্পাদক/মালিক এ বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
তাদের ভাষ্য মতে, শোয়েব কবির নিবন্ধনের আনুষাঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে ২ লাখ টাকা শুধু তার নিজের জন্য দাবি করতেন। এর বাইরে আরও অন্যান্য খরচ দেখিয়ে ৭-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিতেন। টাকার লেনদেন হতো তার বনানীর একটি অফিসে। যদিও তিনি সরাসরি টাকা নিতেন না। নিতেন তার অফিস সহকারী কিংবা তার নানা কুকর্মের পার্টনারদের মাধ্যমে।
জানা গেছে, শোয়েব কবিরের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। চট্টগ্রাম শহরে একসময় পিয়নের চাকরি করলেও টুকটাক লেখালেখি করতেন। এই লেখালেখির ঝোঁক থেকে নিজেকে সাংবাদিক ভাবতে শুরু করেন। পরে দায়িত্বে অবহেলা, নারী কেলেংকারী ও চুরির অপবাদে পিয়নের চাকরিটা খোয়াতে হয়। তবে লেজুড়বৃত্তি আর দালালি করে বনে যান পুরোদমে সাংবাদিক। পরে তার বোনের মাধ্যমে লন্ডনে গিয়ে সময় টিভির প্রতিনিধি হিসেবে বিনা পয়সায় কাজ শুরু করেন।
কিন্তু কয়লা ধুইলে কি আর ময়লা যায়? নারীলিপ্সু এই কথিত সাংবাদিক লন্ডনেই এক নারীকে হেনস্তা শুরু করেন। ওই নারী হেনস্তার অভিযোগ দিলে জেলেও যেতে হয় শোয়েব কবিরকে। তার এই ঘটনাটি নিয়ে তখন বৃটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’ সংবাদ প্রকাশ করেছিল।
যেখানে উল্লেখ করা হয়, বারবার ফোন কল ও ফেসবুক মেসেজের মাধ্যমে ওই মহিলাকে হয়রানি করতো শোয়েব কবির। পরে পুলিশ তাকে থামাতে সতর্কবার্তা দিলেও শোয়েব উল্টো ওই নারীর বাড়িতে গিয়ে উত্যক্ত করতে শুরু করে। এমনকি একদিন ওই নারীর বাড়িওয়ালি শোয়েবকে ঝাড়ু পেটা করে সেখান থেকে তাড়িয়েও দেয় বলে বৃটিশ গণমাধ্যমটিতে উঠে এসেছে।
তবে ঝাড়ু পেটা খেয়েও যেন তার নারীপ্রীতি কমে না! ওই নারীকে উত্যক্ত করার সীমা ছাড়িয়ে গেলে ভুক্তভোগী নারী আদালতের দারস্থ হন। আদালত পরে শোয়েবকে উন্মাদ এবং মাদকাসক্ত আখ্যা দিয়ে ৩ মাসের কারাদণ্ড, ২৫ দিনের রিহ্যাব এবং অর্থদণ্ড দেয়। এবং একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালে যুক্তরাজ্যের ভিসা সারাজীবনের জন্য বাতিল করা হবে বলে সতর্ক করা হয়। এতে নারীপ্রীতির লাগাম টানতে বাধ্য হন শোয়েব।
এইতো গেলো তার অতীত। বর্তমানে এই কথিত সাংবাদিক শোয়েব নিজেকে অনেক বড় জুলাই যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণে ব্যস্ত। নিজের প্রোফাইলে লাগিয়েছে শহীদ মীর মুগ্ধের ছবি। সুযোগ পেলে ছুটে যান বিএনপি নেতাদের বাসায়। লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গেও ছবি তুলে রেখেছেন তার মাফিয়াতন্ত্র টিকিয়ে রাখার সুবিধার্থে।
অথচ এসময় ছিল সাবেক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের অন্যতম চামচা। এইতো কয়েক বছর আগে শোয়েব কবির আলজাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিষ্টার’স ম্যান’ প্রচারিত হওয়ার পর ওই প্রতিবেদনকে সরকার বিরোধী চক্রান্ত ও প্রোপাগান্ডা বলে নিজে সেটির বিরুদ্ধে সময় টিভিতে একটি রিপোর্ট করেন। এই চাটুকারিতার পুরস্কার হিসেবে পরবর্তীতে শোয়েব শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি দেখা করার সুযোগ পান এবং তার স্নেহধন্য একজন সাংবাদিক বলে নিজেকে জাহির করতে শুরু করেন। তার অফিসকক্ষে স্নেহধন্যের প্রমাণস্বরূপ শেখ হাসিনার সাথে তোলা ছবি বড় করে বাঁধাই করে ঝুলিয়ে রাখেন। যেটি দেখিয়ে মূলত নিজের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন শোয়েব।পার্সেন্টিজের মাধ্যমে বিভিন্ন ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেয়া, তদবির বাণিজ্য, এমপি থেকে শুরু করে দলীয় পদ পদবি পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দিতেন সেই ছবির নিচে ক্লায়েন্টদের বসিয়ে।
আর তার এসব পার্সেন্টিজের অবৈধ আয়, তার আমদানি-রপ্তানি ও কসমেটিকস ব্যবসার আড়ালে দেশ থেকে পাচার করতেন নির্বিঘ্নে। এভাবে গত ৫ বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন শোয়েব কবির। আর এসব অর্থ এখন ব্যবহার হচ্ছে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের কাজে।
শুধু তাই নয়, ৫ আগস্ট পরবর্তী সাংবাদিক পরিচয়ে চট্টগ্রামের লালখান বাজারের বাঘঘোনা এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত দিদারুল আলম মাসুমের অফিস ও ঘরবাড়ি পাহারা দেওয়ার দায়িত্বও নিয়েছেন শোয়েব কবির। তার বাড়িতে রাতের আঁধারে লাগানো হয় মিডিয়ার সাইনবোর্ড।
আরও জানা গেছে, শোয়েব যখন ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পল্টি মারতে থাকেন, তখনই ২০২৪ এর নভেম্বরে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান তার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, “আফসোস লাগে যখন দেখি এ ধরনের ব্যক্তিরা নিজ খোলস পাল্টে নিজেদের জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবের সমর্থক বলে দাবি করে। সোয়েব কবির নামের এই ব্যক্তি সময় টেলিভিশনের ইউকে প্রতিনিধি। বিগত সময়ে স্বৈরাচারের দালালি করেছে এখন তিনি ভালো মানুষ সাজার চেষ্টায় আছেন।”
শোয়েব কবির বর্তমানে যুক্তরাজ্য হতে বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। বাইরে বাইরে জুলাই যোদ্ধা সাজলেও তিনি লিপ্ত রয়েছেন সরকারবিরোধী নানান চক্রান্তে। অনেকেই বলাবলি করছেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও যুক্তরাজ্যে পাচার করা টাকা দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়া সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদের গোপন কোনো মিশন নিয়েই চট্টগ্রামে এসেছেন মিডিয়া মাফিয়া হিসেবে পরিচিত শোয়েব কবির।
চাটগাঁ নিউজ/এমকেএন/এএ