সিপ্লাস ডেস্ক: অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ঋণ পাওয়া যায়নি। তবে একটি ঋণের বিষয়ে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা চলমান।
মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে সরকারি দলের এমপি মো. হাবিবর রহমানের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ তথ্য জানান। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উপস্থাপন হয়।
সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, চলতি অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক থেকে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়া গেছে। এ ঋণ পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে পরিশোধযোগ্য।
এম আব্দুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত জাপান সরকার ৯২১ দশমিক ৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় করেছে।
কৃষিঋণের সুদ মওকুফের কোনো পরিকল্পনা নেই
সংরক্ষিত আসনের এমপি নাজমা আকতারের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, কৃষিঋণের সুদ মওকুফের কোনো পরিকল্পনা নেই। এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক আমানতকারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে কৃষকদের ঋণ দেয়। আমানতকারীদের ব্যাংকের সুদ দিতে হয় বলে প্রচলিত নিয়মে ব্যাংকের পক্ষে কৃষকদের মাঝে দেওয়া ঋণের সুদ মওকুফ করা সম্ভব হয় না।
গত অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কর রাজস্ব কম আদায় হওয়ার তথ্য উল্লেখ করে সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টির এমপি সৈয়দ আবু হোসেনের প্রশ্নের জবাবে আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, কোভিড-১৯ পরবর্তীসময়ে অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী মুদ্রানীতি ও ব্যয় সংকোচন নীতি এসব কারণে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় কিছুটা ব্যর্থ হয়েছে।
সরকারদলীয় এমপি এম আব্দুল লতিফের প্রশ্নের উত্তরে ডলার সংকট কমাতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা সংসদে তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। তিনি জানান, ডমেস্টিক ব্যাংকিং ইউনিটকে (স্থানীয় ব্যাংক) তাদের অফশোর ব্যাংকিং অপারেশন থেকে বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল সংগ্রহের প্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, যা ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
রমজান মাসে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুরের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখাসহ পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে এসব পণ্য ৯০ দিনের বিলম্ব মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থায় আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী, যা ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সহজীকরণে দেশের মুদ্রায় লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
বেড়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার
সংসদ সদস্য এম আব্দুল লতিফের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার আগের বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেড়েছিল। টাকার অংকে যা ১২ হাজার ৩৮৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ৬৫২ কোটি ৮ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৯১ হাজার ২৬৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমামের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, করোনার শুরুতে সব তফসিলি ব্যাংককে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রমের আওতায় বিশেষ সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনার প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০২০ সালে অর্জিত নিট মুনাফার ১ শতাংশের বিপরীতে বিশেষ সিএসআর খাতে ব্যাংকসমূহের বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১০৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং এ খাতে ব্যাংকসমূহ বিতরণ করে ১০৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা (মোট বরাদ্দের প্রায় ১০০ দশমিক ৪৮)।
তফসিলি ব্যাংকগুলোর জানুয়ারি-জুন ২০২২ সময়ে সিএসআর কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ ব্যয়কারী ১০টি ব্যাংক হলো- ইসলামী ব্যাংক ২০২ কোটি ১৯ লাখ টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ৩৯ কোটি ৭ লাখ, দি প্রিমিয়ার ব্যাংক ২৯ কোটি ৯৫ লাখ, এক্সিম ব্যাংক ২৮ কোটি ৩৯ লাখ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২২ কোটি ১৬ লাখ, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ২১ কোটি ৬৫ লাখ, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ১৯ কোটি ৮১ লাখ, ঢাকা ব্যাংক ১৪ কোটি ৯৬ লাখ, প্রাইম ব্যাংক ১৪ কোটি ৬৩ এবং ব্র্যাক ব্যাংক ১৪ কোটি ৪৬ লাথ টাকা ব্যয় করে।
ময়মনসিংহ-১১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য কাজিম উদ্দিন আহম্মেদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে ডলার রিজার্ভের পরিমাণ ৩২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
পাচার অর্থ উদ্ধারের আইনগত কার্যক্রম চলমান
সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি লুৎফুন নেসা খানের প্রশ্নের জবাবে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পাচার অর্থ উদ্ধারের আইনগত কার্যক্রম চলমান। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) পাচারকারী বা পাচার করা অর্থের বিষয়ে বিদেশি আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থায় তা সরবরাহ করে।
তিনি জানান, বিদেশে (সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ইত্যাদি) ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনা অথবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে অর্থপাচার বিষয়ে বেশকিছু মামলা বর্তমানে দুদকে তদন্তাধীন।
তিনি বলেন, সিআইডি কর্তৃক পাচার সংশ্লিষ্ট বেশকিছু মামলা চলমান। অর্থপাচার সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ বা তথ্য পেলে বিএফআইইউ আইনের বিধান অনুযায়ী ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদন’ দিতে তা সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থায় পাঠানো হয়।
বিএফআইইউ থেকে গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা অনুসন্ধান ও তদন্তকার্য সম্পাদনপূর্বক প্রয়োজনীয় বিচারিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, দুদকের শিডিউলভুক্ত অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনা কমিশন এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তদন্ত করে। এছাড়া হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থপাচার হলে তা সিআইডি তদন্ত করে।
অর্থপাচার রোধ এবং পাচার অর্থ দেশে ফেরত আনার বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর এবং এ লক্ষ্যে সরকারের সব সংস্থা একযোগে কাজ করছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, অর্থপাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২’ জারি করে। পরে ২০১৫ সালে আইনটির বিভিন্ন ধারা সংশোধন করা হয়। আইনের বিভিন্ন ধারা সংশোধনের মাধ্যমে অর্থপাচার প্রতিরোধের কার্যক্রম আরও জোরদার করা হয়।
মন্ত্রী বলেন, আইনের বিধান অনুসারে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিদেশে পাচার সম্পদ দেশে ফেরত আনার লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্স পাচার অর্থ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কাজ করছে।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহযোগিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা আইন, ২০১২’ জারি করা হয়েছে। এ আইনের আওতায় অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা দিতে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্ধারণ করা হয়।