নিজস্ব প্রতিবেদক: অবিলম্বে আগের সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এজন্য সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকারের পরিবর্তে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে। এছাড়া নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণে তৃণমূল থেকে জনগণের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণকে রাষ্ট্র নির্মাণে অংশগ্রহণ করানোর মধ্য দিয়েই দেশে স্থিতিশীলতা অর্জন, আর্থ-সামাজিক উন্নতির রূপরেখা নির্ণয় এবং সকল প্রকার ফ্যাসিস্ট শক্তি দমনের ক্ষেত্র তৈরি হবে বলে মত দেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) দুপুরে নিজের ফেসবুক আইডিতে এক ভিডিও বার্তায় তিনি এই মত দেন। এসময় রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে অতি দ্রুত অপসারণ করারও দাবি জানান।
ফরহাদ মজহার শুরুতেই রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্যে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের করা একটি দাবিকে সমর্থন করেন। যেখানে আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পান নি, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার এবং এটা হচ্ছে উনার শপথ লঙ্ঘনের শামিল।’
এসময় ফরহাদ মজহার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়ে বলেন, মিথ্যাচার শুধু প্রেসিডেন্ট চুপ্পু করেছেন, এটা ঠিক না। আমরা বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে এই প্রশ্ন এখন তুলতে চাই না যে যারা গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসাবে নিজেদের হাজির করেছেন, তারাও মিথ্যাচার করেছেন। আমরা যখন প্রশ্ন করেছিলাম পদত্যাগপত্র কই? আমাদের দেখান, তখন কেন আপনারা চুপ ছিলেন? কেন প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের পরম অভিপ্রায় হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন না করে আপনারা সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার বানালেন? কেন চুপ্পুর হাতে উপদেষ্টা সরকারের শপথ করালেন? কেন গণঅভ্যুত্থানকে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীন করেছেন? এই তর্ক কি এড়াবার সুযোগ আছে?
ভিডিও বার্তায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, কতিপয় জেনারেলদের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতার লোভে আপনারা এই কাজ করেছেন। তাই কি? এটা ঠিক করেন নি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে চরম বিপদের মুখে আপনারা ফেলে দিয়েছেন। দিল্লির আগ্রাসী ভূমিকা এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক সমীকরণের কথাও ভাবেন নি। ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনর্বাসন এবং আবার ক্ষমতায় ফ্যাসিস্ট শক্তির দ্রুত ফিরে আসার শর্ত আপনারাই করে দিয়েছেন। আমরা বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও আপনারা ফালতু উকিলি যুক্তি দেখিয়েছেন, অথচ আমাদের সংকট মোটেও উকিলি বা সাংবিধানিক সংকট ছিল না। আমাদের সংকট ছিল রাজনৈতিক। একমাত্র রাজনৈতিক ভাবেই তার সমাধান সম্ভব।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং জনগণের বিপুল আত্মত্যাগের শক্তিকে আপনারা উপেক্ষা করেছেন। তাদের রক্তের মূল্য ইতিহাস থেকে আদায় করে নেবার পরিবর্তে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধানের অধীনে সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার গঠন করেছেন। আশা করব আপনারা আপনাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন।
এখন দয়া করে আর উকিলি চতুরতা করবেন না; সাংবিধানিক শূন্যতা কিম্বা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ফালতু যুক্তি দেবেন না। জনগণের অভিপ্রায়ই আইন এবং গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের রায় দিয়েছে, আপনারা সেই ঐতিহাসিক রায় অস্বীকার করবার চেষ্টা করেছেন। আর করবেন না। সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের কলংক থেকে মুক্ত হবার সুযোগ হাজির হয়েছে। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে এখন তার সমাধান করি এবং গণঅভ্যুত্থানকে পূর্ণ বিজয়ের দিকে নিয়ে যাই।
দেশের বর্তমান সংকটের সমাধান কিভাবে করবে, কী করনীয় সেটিও ভিডিও বার্তায় জানান ১৯৭২ সালে প্রবর্তিত সংবিধানের একজন বড় সমালোচক ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, চুপ্পুকে আগে তাড়াতে হবে। তার সমর্থনে কোন জেনারেল দাঁড়ালে তাকেও অপসারণ করতে হবে। জনগণের মিত্র সাধারণ সৈনিক ও সেনা অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে আনতে হবে। যেন ছাত্র-জনতা-সৈনিকের মৈত্রীর ওপর ভিত্তি করে গঠিত গণশক্তি মজবুত হয় এবং জনগণের নতুন রাষ্ট্রশক্তি কায়েম করা যায়। সর্বোপরি আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারি, ফ্যাসিস্ট শক্তিকে দমন করতে পারি এবং সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দিতে পারি। সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকারে পরিবর্তে পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক সরকার গঠন করতে হবে এবং অবিলম্বে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দিতে হবে। কোন সাংবিধানিক ‘অধ্যাদেশ’ নয়।
ভিডিও বার্তায় মাহফুজ, আসিফ, নাহিদ এবং আসিফ নজরুলদের ঐক্যবদ্ধ থাকার উপর জোর দেন। এসময় বিশিষ্ট এই বুদ্ধিজীবী বলেন, ‘জনগণের ঐতিহাসিক রায় বাস্তবায়নের দায় আমাদের সকলের ওপর বর্তায়।’
ভিডিওর শেষাংশে ফরহাদ মজহার বর্তমান সংকট নিরসনে চারটি রূপরেখা দেখিয়ে দেন। যেখানে তিনি ৭২ এর সংবিধান পুরোপুরি বাতিল করার দাবি জানান।
তাঁর দেয়া রূপরেখাগুলা হলো— ১. অনতিবিলম্বে কাঁটাছেঁড়া করা ৭২ এর সংবিধান এবং তার চরম বিকৃত রূপ শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সংবিধান বাতিল করতে হবে। ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার’ নামে কোন কলোনিয়াল বা ঔপনিবেশিক আইনের ধারাবাহিকতা চলবে না। বাংলাদেশের জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ করতে হবে।
২. অবিলম্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই সাময়িক নিষিদ্ধ করতে হবে। জার্মান, ইতালি, স্পেন ও অন্যান্য রাষ্ট্রে ফ্যাসিস্ট সংগঠন নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগ ব্যতিক্রম নয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ফ্যাসিস্ট প্রবণতাও কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
৩. অবিলম্বে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণে তৃণমূল থেকে জনগণের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণকে রাষ্ট্র নির্মাণে অংশগ্রহণ করানোর মধ্য দিয়েই স্থিতিশীলতা অর্জন, আর্থ-সামাজিক উন্নতির রূপরেখা নির্ণয় এবং সকল প্রকার ফ্যাসিস্ট শক্তি দমনের ক্ষেত্র তৈরি হবে।
৪. ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এসব নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। একই সাথে তারা যেন ’২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে কোনোভাবেই জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত হতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা অবৈধভাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল তাদের আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া যাবে না।
চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ/এসএ