নিজস্ব প্রতিবেদক : অনিয়ম-দুর্নীতির শেষ নেই দেশের অন্যতম লোকসানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেলওয়ের। সম্প্রতি বিভিন্ন আর্থিক কার্যক্রমে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে রেলওয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। বছর বছর সরকারের থেকে ভর্তুকি নিয়ে চললেও ক্ষিধে যেন মিটেই না রেলওয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের। যেন দুর্নীতির এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা। তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক জমছে দুর্নীতি ও অপকর্মের অভিযোগের পাহাড়।
জানা যায়, সরকারের দেওয়া ভর্তুকির একটি বড় অংশই চলে যায় রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারাদের পকেটে। আর এরই প্রমাণ মিলেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের বেশ কিছু অডিট আপত্তিতে। সম্প্রতি পরিবহন অধিদপ্তরের অডিট আপত্তির পর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বেশ কিছু দপ্তরে হানা দেয় দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম।
ভুয়া ভ্রমণবিলে সাড়ে ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের পর এবার চাটগাঁ নিউজ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি অডিট আপত্তির প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের অডিটে রেলওয়ের ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিল ও ভাউচার দেখাতে না পারায় সরকারের প্রায় ৭৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯০১ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
অডিট আপত্তির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রেলওয়ে প্রথম শ্রেণির ১৬ জন কর্মকর্তার উত্তোলিত প্রায় ৬১ লাখ ১৯ হাজার ২৩৫ টাকার কোনো বিল দাখিল করা হয়নি। আর এ কারণে এই ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে রেল পাড়ায়। এছাড়াও ক্রয় সংক্রান্ত ব্যাপারেও দুর্নীতিতে এগিয়ে রেল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রেলওয়ের আসবাবপত্র ক্রয়ের জন্য ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৬ টাকার খরচ দেখানো হলেও এরও কোনো বিল-ভাউচার দেখাতে পারেনি কর্মকর্তারা।
অডিট আপত্তির প্রতিবেদনে উঠে আসা ১৬ জন কর্মকর্তার নামের তালিকা ও অর্থ উত্তোলনের পরিমান হলো, লুৎফুন নাহার (তত্কালীন- ডিইও/সদর) ২৭ হাজার ৫০০ টাকা, মো. আমজাদ হোসেন (তত্কালীন- এজিএম/পূর্ব) প্রথম দফায় ১ লাখ ৭৫ হাজার ২৮২ টাকা ও দ্বিতীয় দফায় ৭১ হাজার ৪০০ টাকা, মো. সিরাজ উল্লাহ (তত্কালীন- এসপিও/পূর্ব) ৫৫ হাজার টাকা, সৌমিক শাওন কবির (তত্কালীন- ডিএসই/সদর) ৩২ হাজার ৫০০ টাকা, মো. হাসান ইমাম (তত্কালীন- সিআরএনবি/সদর) ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা উত্তোলন করেছেন।
এছাড়াও এই তালিকায় আরও আছেন নারী কেলেঙ্কারিতে জড়ানো সদ্য বরখাস্ত হওয়া রেলওয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর (টিসি) মো. আনসার আলী। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে বিল-ভাউচার ছাড়াই অর্থ উত্তোলনের অভিযোগ। ডেপুটি সিওপিএস পদে থাকাকালীন কোনো প্রকার বিল-ভাউচার ছাড়াই প্রায় ৫২ হাজার ৫০০ টাকা উত্তলন করেছিলেন তিনি।
আপত্তির তালিকায় আরও আছেন তত্কালীন অতিরিক্ত সিওপিএস সুজিত কুমার বিশ্বাস, তত্কালীন এক্সইএন/পিএন্ডডি/পূর্ব আবিদুর রহমান, তত্কালীন অতিরিক্ত সিএসটিই/পূর্ব মইনুল ইসলাম, তত্কালীন এসপিও/পূর্ব মো. সিরাজ উল্লাহ, তত্কালীন অতিরিক্ত সিই/পূর্ব আব্দুল জলিল, একে একে তিন দফায় প্রায় এক লাখ টাকা উত্তোলন করা তত্কালীন অতিরিক্ত সিওপিএস সুজিত কুমার বিশ্বাস।
আরও আছেন তিন দফায় প্রায় সাত লাখ টাকা উত্তোলন করা তত্কালীন এসডব্লিউও/পূর্ব মো. আবু খালেদ চৌধুরী, ডেপুটি সিসিএম/পূর্ব ইতি ধর, প্রায় সাত লাখ টাকা উত্তোলন করা ত্বতকালীন এজিএম/পূর্ব গৌতম কুমার কুন্ডু ও ত্বতকালীন অতিঃ সিএসটিই/পূর্ব মইনুল ইসলাম।
এদিকে, এই অডিট আপত্তি প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও উপযুক্ত নথিপত্রের অভাবে নিষ্পত্তির ধারে কাছেও যেতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ। তারপরও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের।
রেল সংশ্লিষ্টদের মতে, এ ধরনের অনিয়ম শুধুমাত্র সরকারের জন্য নয়, বরং দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাকেও বাধাগ্রস্ত করছে। তাদের দাবি, দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত এবং অনিয়ম রোধে কার্যকর পদক্ষেপ হাতে নেওয়া জরুরি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের আর্থিক অনিয়ম দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমি মনে করি, সরকারের বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা।
এ বিষয়ে রেলওয়ে টিএলআর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ হোসেন বলেন, কর্মচারীদের নামে কোন ধরণের অভিযোগ আসলেই বিভাগীয় তদন্ত ছাড়াই বদলি, বরখাস্ত যেন এক অলিখিত নিয়ম। তবে কর্মকর্তাদের দুর্নীতি কারোই যেন চোখে পড়ে না।
তিনি বলেন, অডিট আপত্তিসহ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বড় বড় অভিযোগ প্রমাণিত হলেও প্রতিবার তারা থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তদন্ত চলমান অজুহাতে কেটে যায় যুগের পর যুগ।
উদাহরণ স্বরূপ মোহাম্মদ হোসেন আরও বলেন, ২০১৯ সালে জেটিআই নিয়োগে (ডিপার্টমেন্টলি) দুর্নীতির অভিযোগে তৎকালীন এডিশনাল সিইউপিএস জাকির হোসেনসহ অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গঠন করা হলেও আজও তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারেনি কমিটি। এছাড়াও ২০২১ সালে অফিস সহকারী সোহেলকে অবৈধ টাকা প্রদান করতে গিয়ে জাকির হোসেন এডিশনাল সিওপিস ধরা পড়েন। এ নিয়ে একাধিক সংবাদও প্রকাশিত হয়। তবে ৪ বছর ধরে চলমান এ তদন্ত কমিটির রিপোর্টও এখনো হিমঘরে। কর্মচারীদের পান থেকে চুন খসলেই সাসপেন্ড-চার্জসীট, কর্মকর্তাদের বেলায় ফুলের মালা, পদোন্নতি! এ কারণে রেলওয়ে এখনো লাভের মুখ দেখছে না।
তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের এ সকল অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে রেল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এমন দুর্নীতির অভিযোগ আমাদের হাতেও এসেছে। আমরা কাজ করছি, সকলের বিরুদ্ধে পুনর্তদন্ত হবে। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
তিনি বলেন, রেলের লোকসান কমাতে আমরা বদ্ধপরিকর। আগে রেলের লোকসান কমাবো, তারপর লাভের আসা করবো।
চাটগাঁ নিউজ/এইচএস/এসএ