চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক: রমজান হলো আত্মশুদ্ধির মাস, এ মাসে একজন মুমিন তার হৃদয়কে তাকওয়ার আলোয় আলোকিত করে। এটি শুধু রোজা রাখার মাস নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মসংযম ও আল্লাহভীতি অর্জনের শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণের সময়। তাকওয়া শব্দটি কোরআনে বহুবার এসেছে এবং এটি মূলত আল্লাহভীতির মাধ্যমে নিজেকে গুনাহ থেকে রক্ষা করার নাম। রমজান মাসে সঠিকভাবে রোজা পালন করলে মুমিনের হৃদয়ে তাকওয়ার জন্ম হয়, যা তাকে পরবর্তী জীবনে গুনাহ থেকে দূরে রাখে এবং পরকালীন মুক্তির পথ দেখায়।
তাকওয়ার সংজ্ঞা
তাকওয়া শব্দটি আরবি ‘ওয়াক্বায়া’ মূল ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘রক্ষা করা’ বা ‘সুরক্ষা প্রদান করা’। ইসলামী পরিভাষায় তাকওয়া হলো আল্লাহকে ভয় করে তাঁর বিধান মেনে চলা এবং হারাম কাজ থেকে দূরে থাকা। তাফসিরে বায়জাবিতে তাকওয়ার তিন স্তরের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
এক. শিরক থেকে বেঁচে চিরস্থায়ী শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং তাদের তাকওয়ার বিষয়ে স্থিত করে রাখলেন।’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ২৬)
দুই. করণীয় কিংবা বর্জনীয়—এমন সব ধরনের কাজ হতে বিরত থাকা, যা মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত করে। কারো কারো মতে, সগিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। তাকওয়ার এই সংজ্ঞাটি প্রসিদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার বাণী—‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং পরহেজগারি অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের প্রতি আসমানি ও পার্থিব নিয়ামত উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদের পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের কারণে।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৯৬)
তিন. যেসব বস্তু আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন করে তা পরিহার করে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর প্রতি ধাবিত হওয়া। এই স্তরের তাকওয়া বেশি কাম্য।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা, আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত তেমনি ভয় করতে থাকো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০২)
রমজান তাকওয়া চর্চার মাস : কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩)
এই আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। রোজার মাধ্যমে একজন মুমিন নিজের প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে এবং আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি আরো মনোযোগী হয়। এ মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয় এবং মুমিনরা তাদের ইবাদতে অধিক মনোযোগী হয়।
নিম্নে রমজানের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করা হলো—
রোজার মাধ্যমে আত্মসংযম
রোজা মানুষের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায়। ক্ষুধা ও পিপাসার মাধ্যমে মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা অনুভব করে এবং আল্লাহর আদেশ পালনে আরো মনোযোগী হয়। আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, ‘তোমাদের কারো যদি কোনো দিন রোজা পালনরত অবস্থায় ভোর হয়, তবে সে যেন স্ত্রী সম্ভোগ ও অন্যায় আচরণ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা ঝগড়া-বিবাদ করে, তবে সে যেন বলে আমি রোজা পালনকারী, আমি রোজা পালনকারী।’ (সহিহ মুসলিম হাদিস : ১১৫১)
গুনাহ থেকে দূরে থাকা
রমজান মাসে একজন মুমিনকে নিজের চরিত্র পরিশুদ্ধ করতে হয়। মিথ্যা বলা, গিবত করা, হারাম কাজ করা—এসব থেকে দূরে থাকার শিক্ষা রোজা দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রোজা (জাহান্নামের) আগুন থেকে ঢালস্বরূপ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০৭৮)
এখানে রোজাকে ঢাল বলা হয়েছে, যা তাকওয়া অর্জনের অন্যতম পথ। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এই পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।(সহিহ বুখারি হাদিস : ১৯০৩)
আল্লাহ তাআলা আমাদের দেখেন, সর্বাবস্থায় দেখেন, তাঁর দৃষ্টি থেকে আমরা কখনোই লুকাতে পারি না—এ বিশ্বাস আমাদের মন-মস্তিষ্কে যতটা জাগরূক থাকবে, গুনাহের কাজ থেকে ততটাই বেঁচে থাকতে পারব। তাই আল্লাহ তাআলা দেখছেন—এ বিশ্বাসে কেউ যখন গোপনে পানাহার থেকে বিরত থাকছে, পরে যখন তার সামনে আরেকটি গুনাহের কাজ আসে, তখনো সে বিশ্বাসই তাকে এ গুনাহ থেকেও বাধা দিয়ে রাখে। আর রমজান মাসজুড়ে কেউ যখন এভাবে সব রকমের গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, পরবর্তী সময়গুলোতেও তার জন্য তাকওয়ার এ পথ ধরে চলা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
এই হাদিস প্রমাণ করে যে শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকাই যথেষ্ট নয়, বরং তাকওয়া অর্জন করতে হলে সর্বপ্রকার পাপ ও অনৈতিক কাজ থেকেও বিরত থাকতে হবে। রোজার হক পরিপূর্ণরূপে আদায় করতে হলে অন্যায় কাজ ছাড়তে হবে, অন্যায় কথা ছাড়তে হবে, পাপে জড়ানো যাবে না। তবেই হবে যথার্থ রোজা পালন হবে, অন্যথায় এ রোজা রাখার ফরজ দায়িত্বটুকু হয়তো পালিত হবে, কিন্তু এতে রোজার প্রাণ বলে কিছু থাকবে না।
না দেখেও আল্লাহ তাআলাকে ভয় করার এ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে আমরা যে কেবলই হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারব, তা নয়; বরং এ প্রশিক্ষণ আমাদের যতটা পাকাপোক্ত হবে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ইবাদতগুলোও ততটা প্রাণবন্ত হবে।
তারাবির নামাজ
রমজান মাস হলো কোরআন নাজিলের মাস। এ মাসে তারাবির নামাজের মাধ্যমে কোরআন শ্রবণ করা এবং বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা তাকওয়া অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আল্লাহ বলেন, ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৫)
কোরআন তিলাওয়াত
রমজান কোরআন তিলাওয়াতের শ্রেষ্ঠ সময়। এ মাসে কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করলে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। তাই আমাদের উচিত এ মাসকে কোরআনের আলোয় উদ্ভাসিত করা এবং এর শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গঠন করা। আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, কিয়ামতের দিন রোজা এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি ওকে পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং ওর ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। আর কোরআন বলবে, আমি ওকে রাত্রে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং ওর ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। নবী (সা.) বলেন, অতএব, ওদের উভয়ের সুপারিশ গৃহীত হবে। (মুসনাদের আহমদ, হাদিস : ৬৬২৬)
সদকা ও দানশীলতা
রমজান মাসে দান-সদকা বৃদ্ধি পায়, যা তাকওয়ার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। রাসুল (সা.) রমজানে সবচেয়ে বেশি দান করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ছিলেন সবচেয়ে দানশীল মানুষ, আর রমজান মাসে তিনি আরো বেশি দানশীল হয়ে উঠতেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬)
আর দান-সদকা অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং মুমিনের মধ্যে বিনয় ও আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে।
লাইলাতুল কদর ও দোয়া
রমজানের শেষ দশ রাত হলো সবচেয়ে মূল্যবান, কারণ এ সময় লাইলাতুল কদর রয়েছে, যা হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এই রাতগুলোতে ইবাদত করার মাধ্যমে মুমিনের তাকওয়া বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেন, ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ৩)
আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের পূর্ণ ফায়দা অর্জন করার তাওফিক দান করুন এবং আমাদের হৃদয়ে তাকওয়ার আলো প্রজ্বলিত করুন।
চাটগাঁ নিউজ/এমকেএন