সিপ্লাস ডেস্ক: কানাডার শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার ঘটনায় ভারত সরকারের দিকে সরাসরি অভিযোগের আঙুল তোলার পর প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো চাইছেন যে, কানাডার মিত্র দেশগুলো তাদের পাশে দাঁড়াক। কমনওয়েলথ ছাড়াও উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট (ন্যাটো) এবং জি-৭ এর সদস্য দেশ কানাডা।
ট্রুডো চান ন্যাটো এবং জি-৭ ভারতের বিরুদ্ধে আনা তাদের অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখুক। তার মতে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, যা অত্যন্ত গুরুতর। ট্রুডো জানিয়েছেন, মিত্র দেশ এবং ভারতের কাছে এ বিষয়টি উত্থাপন করার আগ পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করেছেন।
মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) পার্লামেন্ট হিলে জাস্টিন ট্রুডো সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে আমরা যা জানতে পেরেছি প্রথমে সেটা আমাদের সহযোগী দেশগুলোকে জানাতে চেয়েছিলাম। আবার আমরা বিষয়টি ভারতের কাছেও গুরুত্ব সহকারে উত্থাপন করেছি।
তবে ভারত জাস্টিন ট্রুডোর এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বলছে যে, এটি কানাডায় খালিস্তানিদের আশ্রয় দেওয়ার ইস্যু থেকে মনোযোগ ঘোরানোর জন্য করা হচ্ছে।
মিত্র দেশগুলোকে আগেই জানিয়েছিল কানাডা
ন্যাটো এবং জি-৭ ছাড়াও ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স অ্যালায়েন্সেরও সদস্য কানাডা। এর অন্যান্য সদস্য দেশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। কানাডার তোলা অভিযোগ অন্য চারটি দেশই অত্যন্ত গুরুতর বলে অভিহিত করেছে।
পশ্চিমা একটি সূত্রের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, ফাইভ আইজ অ্যালায়েন্স হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যার নিন্দা জানিয়ে প্রকাশ্যে একটি যৌথ বিবৃতি না দিলেও জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে বিষয়টি উত্থাপন করেছে। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, জাস্টিন ট্রুডো ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও এই ইস্যুতে কথা বলেছেন।
ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স অ্যালায়েন্সের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলো একে অপরের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করে থাকে। এর সদস্য দেশ অস্ট্রেলিয়া গত কয়েক বছরে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক দৃঢ় করেছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের পর থেকেই ভারতের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।
আবার অস্ট্রেলিয়ায় হিন্দু মন্দিরগুলোতে খালিস্তান-সমর্থকদের ক্রমবর্ধমান হামলার নানা খবর আসছে এবং নরেন্দ্র মোদী অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজের কাছেও ওই হামলার বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন।
পশ্চিমা কূটনৈতিক তৎপরতা তুঙ্গে
কানাডা ও ভারতের মধ্যে যে কূটনৈতিক বিরোধ শুরু হয়েছে, তা যেন অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব না ফেলে সেজন্যই এখন প্রবল প্রচেষ্টা চালাবে পশ্চিমা বিশ্বের মন্ত্রী এবং কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিগুলো এই মুহূর্তে কখনোই চাইবে না যে এমন একটি বিরোধ তৈরি হোক যা ভারতের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে দেবে।
বিশ্ব রাজনীতির বৃহত্তর দাবার কোটে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। তারা যে শুধুই একটি ক্রমবর্ধমান শক্তি, তা নয়। বরং, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ এবং পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। আবার চীনের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সুরক্ষা প্রাচীর হিসেবেও ভারতকে দেখে পশ্চিমা দেশগুলো।
এটা ভারতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে দেখা গিয়েছিল যখন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে নাম উল্লেখ না করেই একটি চূড়ান্ত বিবৃতিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো।
এই বিবৃতি নিয়ে বিতর্ক এড়ানোর মাধ্যমে তারা ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রক্ষা করার পথ বেছে নিয়েছিল, যদিও তাতে আবার কিয়েভের একটা অংশ ক্ষুব্ধ হয়। পশ্চিমা কূটনীতিকদের মধ্যে আরেকটি আশঙ্কা আছে যদি বিভিন্ন দেশ কানাডা-ভারত বিরোধে কোনো একটা পক্ষ নেওয়া শুরু করে।
গত জুনে কানাডার পশ্চিমাঞ্চলে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারকে হত্যার পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। চলতি সপ্তাহের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এমন অভিযোগ তোলার পর দুদেশের মধ্যে যথেষ্ট উত্তেজনা তৈরি হয়।
ভারত সম্প্রতি নিজেকে উন্নয়নশীল দেশের নেতা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এই দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ কঠোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যেন এসব দেশকে বোঝানো যায় যে, এই যুদ্ধ তাদের কাছে এবং তাদের অর্থনীতির কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ।
কূটনীতিকরা চাইবেন না যে তাদের সেই প্রচেষ্টায় ভারত-কানাডা বিতর্ক কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলুক। দুটি কমনওয়েলথ দেশের মধ্যে উত্তর বনাম দক্ষিণ বিরোধ অথবা একটি ট্রান্স-আটলান্টিক শক্তি আর একটি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসেবে পরিগণিত হয়।
কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন ট্রুডো।
যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের অবস্থান
আপাতত কানাডার মিত্ররা বিশ্বস্ত অথচ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। হোয়াইট হাউজ বলছে, যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যার অভিযোগের বিষয়ে ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ আর কানাডার যে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো যেখানে বৃহৎ শিখ সম্প্রদায় রয়েছে, সেখানে সবসময় এই জাতীয় কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ব্রিটেন কানাডার গভীর উদ্বেগগুলো খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনবে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জলির সঙ্গে তাদের তোলা অভিযোগগুলো নিয়ে আগেই কথা হয়েছে এবং কানাডা যা বলছে সেগুলোকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাজ্য। কানাডা এবং ভারত উভয়ই যুক্তরাজ্যের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং তারা কমনওয়েলথের অংশীদার।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ওই অভিযোগুলোর ব্যাপারে ক্যানবেরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং তাদের উদ্বেগের ব্যাপারে ভারতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। তাই আপাতত পশ্চিমা দেশগুলো তদন্তের অগ্রগতির ওপর নজর রাখবে।
আবার কানাডীয় গোয়েন্দারা যা জেনেছেন, সে তথ্য কয়েকটি মিত্র দেশের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হতে পারে। যদি সেটা করা হয়, তাহলে পশ্চিমা শক্তিকে বেছে নিতে হবে যে দিল্লি নাকি অটোয়া, কাকে তারা সমর্থন করবে? আইনের শাসনের নীতিমালা, না রাজনীতির কঠোর বাস্তবতা- এই দুইয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে তাদের।
অতীতে রাশিয়া, ইরান বা সৌদি আরবের মতো দেশের বিরুদ্ধে যখন ভিন দেশে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তখন পশ্চিমা বিশ্ব সেসব ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। তারা চাইবে না যে ভারতও সেই তালিকাভুক্ত হোক।
সূত্র: বিবিসি বাংলা