ভারতের পেঁয়াজে বাংলাদেশের না, বুক চাপড়াচ্ছেন ভারতীয় রপ্তানিকারকরা!

বাণিজ্য ডেস্ক: ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দাম একদম তলানিতে, তবুও দেশটির পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা এই দুরবস্থায় হতবাক হলেও এর নেপথ্যে মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম। কারণ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ভারতের পেঁয়াজ থেকে।

নয়াদিল্লি অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পেঁয়াজ রপ্তানিতে বারবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বাংলাদেশ এখন বিকল্প উৎস হিসেবে পাকিস্তান ও চীনের দিকে ঝুঁকেছে। ফলে ভারতের দীর্ঘদিনের এই একচ্ছত্র আধিপত্য এখন হুমকির মুখে।

ভারতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একসময় ভারত থেকে রপ্তানিকৃত মোট পেঁয়াজের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই কিনত বাংলাদেশ। অথচ গত আট মাসে বাংলাদেশ নামমাত্র পেঁয়াজ আমদানি করেছে। যদিও ভারতের তুলনায় ঢাকার বাজারে পেঁয়াজের দাম প্রায় তিনগুণ বেশি। শুধু বাংলাদেশ নয়, সৌদি আরবও গত এক বছরে ভারত থেকে খুব সামান্যই পেঁয়াজ কিনেছে।

ভারতীয় রপ্তানিকারকদের দাবি, ভারত থেকে অবৈধভাবে পাচার হওয়া পেঁয়াজ বীজ ব্যবহার করে তাদের ঐতিহ্যবাহী ক্রেতা দেশগুলো এখন নিজেরাই পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠছে। এটি ভারতের পেঁয়াজ বাণিজ্যের আধিপত্যে বড় আঘাত হানছে।

হর্টিকালচার প্রোডিউস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এইচপিইএ) সাবেক প্রধান ও প্রবীণ পেঁয়াজ রপ্তানিকারক অজিত শাহ বলেন, ‘আমরা এতদিন আমাদের পণ্যের মানের জন্য বাড়তি দাম দাবি করতে পারতাম। কিন্তু দীর্ঘ সময় আমরা যখন বাজারে ছিলাম না, তখন আমাদের ক্রেতারা বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজে নিয়েছে। এখন তারা আর মানের তুলনা করে না, বরং প্রতিযোগীদের সঙ্গে আমাদের দামের তুলনা করে।’

রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার প্রভাব

২০২৩ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। এর আগেও ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ছয় মাস এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ মাসের জন্য রপ্তানি নিষিদ্ধ ছিল।

এই ঘন ঘন নিষেধাজ্ঞার ফলে যেসব বাজার ভারতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে পেঁয়াজের দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। ২০২০ সালে ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি নীতির ঘন ঘন পরিবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ একটি কূটনৈতিক নোটও পাঠিয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব কৃষকদের সুরক্ষা দিতে এবং স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছে না।

পরিসংখ্যান যা বলছে

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশে ৭.২৪ লাখ টন পেঁয়াজ রপ্তানি করেছিল, যা ওই বছর ভারতের মোট ১৭.১৭ লাখ টন রপ্তানির ৪২ শতাংশ ছিল। অথচ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর সময়কালে ভারত বাংলাদেশে মাত্র ১২,৯০০ টন পেঁয়াজ রপ্তানি করতে পেরেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মনে করছে, ঢাকার বর্তমান রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ভারতীয় পেঁয়াজ চালানের প্রতি এই অনাগ্রহের কারণ হতে পারে।

তবে রপ্তানিকারকরা ভিন্ন কথা বলছেন। তাদের মতে, অভ্যন্তরীণ দামের ওপর ভিত্তি করে বারবার রপ্তানি নীতি পরিবর্তন করার কারণেই ভারতের দীর্ঘদিনের ক্রেতারা অন্য দেশের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছে।

ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বোর্ড অফ ট্রেডের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য পাশা প্যাটেল বলেন, ‘আমরা শুধু আমাদের অনেক ঐতিহ্যবাহী ক্রেতাই হারাইনি, বরং তারা ভারতীয় পেঁয়াজ বীজ ব্যবহার করে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে শুরু করেছে।’ উল্লেখ্য, কৃষকদের বিক্ষোভের পর মহারাষ্ট্র সরকার গঠিত পেঁয়াজ নীতি কমিটির প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

সৌদি আরব ও অন্যান্য বাজারের চিত্র

রপ্তানিকারকরা জানান, সৌদি আরবও প্রায় এক বছর ধরে ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে খোঁজ নেওয়া হলে রপ্তানিকারকরা জানান, সৌদি কর্তৃপক্ষ ভারতীয় রপ্তানিকারকদের আমদানির অনুমতিপত্র দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

এইচপিইএ সরকারকে জানিয়েছে, ‘সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে যে তারা স্থানীয় ফলনের পাশাপাশি ইয়েমেন ও ইরান থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে পেঁয়াজ পাচ্ছে।’

অন্যদিকে ফিলিপাইনও এখন কেবল তখনই ভারত থেকে পেঁয়াজ কেনে, যখন চীন থেকে আমদানি করা সম্ভব হয় না। ২০২০-২১ সালে ভারত সৌদি আরবে ৫৭ হাজার টন পেঁয়াজ রপ্তানি করেছিল, যা পরবর্তী বছরগুলোতে ক্রমশ কমে ২০২৫-২৬ সালে মাত্র ২২৩ টনে নেমে এসেছে।

বীজ পাচার ও রপ্তানিকারকদের উদ্বেগ

প্রতিবেশী দেশগুলো এখন ভারতীয় বীজ ব্যবহার করেই ভারতীয় পেঁয়াজের ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগী দেশগুলোতে পেঁয়াজ বীজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করার জন্য হর্টিকালচার কমিশনারের কাছে দাবি জানিয়েছেন।

এইচপিইএ-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট বিকাশ সিং বলেন, ‘বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতীয় পেঁয়াজ বীজ ব্যবহার করে পেঁয়াজ উৎপাদন করছে। এই প্রবণতা ভারতীয় কৃষকদের জন্য এক গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। চীন ও পাকিস্তানেও ভারতীয় পেঁয়াজ বীজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।’

চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ

Scroll to Top