‘বৈষম্যবিরোধী’ তকমা লাগিয়ে শতাধিক গ্রুপ সক্রিয় অপকর্মে, দিশেহারা প্রশাসন

নিজস্ব প্রতিবেদক : গণঅভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে যখন রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের মহাযজ্ঞ চলছে। চারিদিকে দিন বদলের হাওয়া বইছে। তখন এক শ্রেণির অসাধু চক্র স্যোশাল মিডিয়ায় ‘বৈষম্যবিরোধী’ নাম ভাঙিয়ে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম, ইমো বা অন্য কোন প্রাযুক্তিক অ্যাপসে গ্রুপ খুলে অপরাধ কর্ম সংগঠিত করে যাচ্ছে। তবে এসব গ্রুপগুলো প্রকৃত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত কিনা বা সমন্বয়কদের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনকৃত কিনা- সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

অনলাইন গ্রুপভিত্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরে রয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। আবার এমন পরিস্থিতিতে প্রকৃত অপরাধী বা ঘটনার তদন্ত অনুসন্ধানেও সংস্থাটিকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। বর্তমানে এই ধরণের শতাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।

তবে সময়ের সুযোগে অপরাধী চক্রের এমন ডিজিটালি কার্যকলাপে একদিকে যেমন জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, তেমনি সমাজে এর বিরুপ প্রভাবও পড়ছে বলেও সচেতন মহলের ধারণা।

১৩ আগষ্ট মধ্যরাতে ছিনতাইকারী সন্দেহে চট্টগ্রামের আখতারুজ্জামান উড়াল সেতুর নিচে ২ নম্বর গেট মোড়স্থ ট্রাফিক আইল্যান্ডের দুটি খুঁটির সঙ্গে দুই হাত বেঁধে ‘মধু হই হই আরে বিষ হাওয়াইলা’ গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নেচে-গেয়ে শাহাদাত হোসেন (২৪) নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) নগরীতে পৃথক অভিযান চালিয়ে ফরহাদ আহমেদ চৌধুরী জুয়েল (৪২), মো. সালমান (১৬) এবং আনিসুর রহমান ইফাত (১৯) নামে তিন আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

গ্রেফতার পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানায়, ভ্যানচালক শাহাদাত হোসেনকে পিটিয়ে নির্দয়ভাবে হত্যায় জড়িতরা ‘চট্টগ্রাম ছাত্র জনতা ট্রাফিক গ্রুপ’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা গ্রেফতার জুয়েল ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটির অ্যাডমিন। অপর গ্রেফতার মো সালমান ও আনিসুর রহমান ইফাত একই গ্রুপের সদস্য।

স্যোশাল মিডিয়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশি নিস্ক্রিয়তা, রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কার সংস্কৃতি চর্চার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই মেসেঞ্জার গ্রুপ, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, ইমো গ্রুপ বা অন্য কোন অ্যাপসে গ্রুপ খুলে সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের প্রচারণা চালাচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু কিছু গ্রুপের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড চোখে পড়লেও অনেকেই আবার গ্রুপ খুলে সেগুলোকে অপকর্ম পরিচালিত করার সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে।

ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বৈষম্যহীন নাগরিক সমাজ, টিম ওয়াইজি, নতুন ব্রিজ এলাকায় ট্রাফিক পরিস্কার টিম, পতেঙ্গা সিবীচ সংস্কার, বহদ্দারহাট এলাকা সংস্কার ছাত্র-জনতা, চট্টগ্রাম বাজার দাম পর্যালোচনা ও নিয়ন্ত্রণ বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী, বৈষম্যবিরোধী শ্রমিক আন্দোলনসহ শতাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু গ্রুপ সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকা্ড পরিচালনা করলেও কিছু গ্রুপের দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম নেই। তারা গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করছে সদস্যদের সংঘবদ্ধকরণ ও যোগাযোগ তৈরির মাধ্যম হিসেবে। শাহাদাতের হত্যাকারী অপরাধীরা ‘চট্টগ্রাম ছাত্র-জনতা ট্রাফিক গ্রুপ’র সদস্য এবং শাহাদাতকে ছিনতাইকারী বলে আটক করে পিটানোর ক্ষেত্রেও তারা গ্রুপে সবাইকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বলে পুলিশ জানায়।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার এডিসি (পিআর) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, শাহাদাতকে ধরে পেটানোর সময় আসামিরা গ্রুপের মাধ্যমে পারস্পরিক আলোচনা করে সবাইকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানায়। এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১৩০ জন। বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পর সড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ নানা কর্মকাণ্ডে যারা আমাদেরকে সহযোগিতা করেছে তাদের সাথে এই গ্রুপের কোন সম্পর্ক খুজে পাওয়া যায়নি। আপাত দৃষ্টিতে এদের কর্মকাণ্ড মহৎ বলে মনে হলেও এরা সময়ের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ সুবিধা আদায়ে পাঁয়তারায় আছে। পুলিশ ঘটনায় জড়িত সবাইকে দ্রুত সময়ে আইনের আওতায় আনবে।

তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তির সাহায্যে এরকম গ্রুপগুলোকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যেসব গ্রুপ বা সদস্যরা সরাসরি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে রেজিস্ট্রিকৃত বা সম্পর্কিত সেগুলো চিহ্নিত করে বাকিগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিষয়টি নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল করিম চাটগা নিউজকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের নামে ফায়দা হাসিলে অসাধু চক্রের অনেকেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ করে অপকর্ম চালাচ্ছে।

তিনি জানান, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে অপরাধীরা নৃশংস থেকে নৃশংসতর অপরাধের ধরণ উদ্ভাবন করছে। এটি প্রজন্মের মানসিক বিকলাঙ্গ ছাড়া আর কিছুই নয়। মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মানুষ আইনকে হাতে তুলে নিচ্ছে। মব জাস্টিস চলছে। মানুষ মানুষকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশ নিস্ক্রিয় থাকলেও এখন আস্তে আস্তে সংস্থাটি সক্রিয় হয়ে উঠছে। পুলিশ সক্রিয় হলে দেশের জননিরাপত্তা, অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ হতে বাধ্য।

চাটগা নিউজ/ উজ্জ্বল/এসএ

Scroll to Top