বিয়ের অনুষ্ঠানে ‘মব তাণ্ডব’— কোন অবক্ষয়ের অশনি সংকেত?

আ.লীগ নেতাদের সন্তানদের বিয়ে শাদি নিয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা!

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ   ধর্মীয় রীতিতে আকদ, গায়ে হলুদসহ মোট তিনটি অনুষ্ঠান হয়ে গিয়েছিলো হাজারো অতিথির অংশগ্রহণে। কিন্তুু জাঁকজমকপূর্ণ এইসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না বরের  আপন  চাচাতো বোন সাবেক এমপি খাদিজাতুল আনোয়ার সনি।

তা সত্বেও  বিয়ের রাতে  চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা ফখরুল আনোয়ারের ছেলের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাবেক দুজন সাংসদ এসেছেন এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এর জেরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার হামলা, মারধর ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির ঘটনাটি এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে।

ফলে আওয়ামী লীগ নেতাদের ছেলে মেয়ের বিয়ে শাদি নিয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে সারাদেশে।

আওয়ামী লীগের পলাতক নেতা আটকের নামে মব ক্রাইম চালিয়ে একটি অভিজাত শ্রেণির বিয়ে অনুষ্ঠান পণ্ড করা, আয়োজকদের সামাজিক সম্মানহানি করার এমন কর্মকাণ্ড দেশজুড়ে নানা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রশাসনের প্রায় সবাই দাওয়াত পেয়েছিলেন এই বিয়েতে এমনটাও নিশ্চিত করেছে দু পক্ষের লোকজন। তবুও কেন এমনটা হলো?

সচেতন মহলের মন্তব্য, বিয়ে বাড়িতে নেতাদের উপস্থিতির গুজব ছড়িয়ে তাদের আটকের বাহানায় পরিকল্পিতভাবে একটি পক্ষ এটি করিয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতাকে এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক বা অন্যকোন শত্রুতার বশে কাউকে সামাজিকভাবে হেয় করার মানসে যে কেউ এমন ঘটনা ঘটাতে পরিকল্পনা নিতে পারে।

এতে সামাজিক সংক্রমণে পরিণত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ প্রশ্ন করেছেন, আদৌ এই দুই  সাবেক সাংসদ কি দেশে আছে? তাতো নিশ্চিত নয় কেউ কিংবা প্রশাসন! চলমান পরিস্থিতিতে তারা কি আদৌ প্রকাশ্যে আসার পরিবেশ দেশে আছে? এমন প্রশ্ন করে রীতিমতো অবাক হচ্ছেন। চট্টগ্রামে এমন ইতিহাস ইতো পূর্বে ঘটেনি বলে দলমত নির্বিশেষে সবাই হতবাক!

এ বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে অ্যাডভোকেট জিয়া আহসান হাবীব চাটগাঁ নিউজকে বলেন, আমাদের ছেলেরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন করেছে। তবে মব ক্রাইম করে কাউকে সোশ্যালি ব্ল্যাকমেইল করে সামাাজিকভাবে হেয় করার জন্য তো আন্দোলন করেনি। ছাত্ররা লেখা পড়ায় ফিরে যাবে এমনই তো কথা ছিল। কিন্তু তারা যে রাজনৈতিক চর্চায় মনোনিবেশ করেছে এই প্র্যাকটিস সমর্থন করি না।

তিনি বলেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ খদিজাতুল আনোয়ার সনি ও নজিবুল বশর ভান্ডারী এসেছেন এমন গুজব ছড়িয়ে দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা যে অপকর্ম করেছে তা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা আয়োজকদের সামাজিক সম্মান খর্ব করা হয়েছে। বিয়েবাড়িতে উপস্থিত সকল অতিথিদের মাঝে আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছে। তাদেরকে মানহানি করা হয়েছে। এটা সমাজ অধঃপতনের একটা অশনি সংকেত। তরুণ প্রজন্মকে এমন কর্মকাণ্ড থেকে বের হয়ে আসতেই হবে। এ ব্যাপারে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।

তিনি বলেন, বড় বড় রাঘব বোয়ালদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে ছুনোপুটি নিয়ে জল ঘোলা করার বিষয়টি উদ্বেগজনক।

এই আইনজীবী আরও বলেন, জনগণের অধিকার আছে কোন আসামিকে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক বা গ্রেফতার না করে তাহলে জনগণ সেক্ষেত্রে তাদেরকে আটক করে আইনের হাতে তুলে দিতে পারে। তবে আসামিকে অত্যাচার নির্যাতন করতে পারবে না। এক্ষেত্রে জনগণ ওই আসামিকে ঘেরাও করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আনতে পারে। এমনকি কোন নারী আসামি হলে তার জন্য প্রয়োজনে সারারাত পাহারা দিয়ে সকালবেলা নারী পুলিশ সদস্য এনে তাকে আটক বা গ্রেফতার করাতে পারে। কিন্তু এটা কোন ধরণের ঘটনা, ছাত্র-জনতা একেবারে বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে এমন কাণ্ড ঘটাবে?

জানা গেছে, ১ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে নেভি কনভেনশন সেন্টারে ফখরুল আনোয়ার চৌধুরীর ছেলে সৈয়দ মিনহাজুল আনোয়ারের সঙ্গে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের নাতনি সৈয়দা মাহবুবা হোসনে আরা মনজুরের বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। মাহবুবা হোসনে আরা মনজুর আলমের বড় ছেলে নিজামুল আলমের মেয়ে।

অপরদিকে, বরের বাবা ফখরুল আনোয়ার চৌধুরী আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনির চাচা। তাঁর ভাই ও খাদিজাতুলের বাবা প্রয়াত রফিকুল আনোয়ার চৌধুরীও সংসদ সদস্য ছিলেন।

ঘটনার বর্ণনা

শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১০টায় খবর ছড়িয়ে পড়ে, নগরীর টাইগারপাসস্থ নেভি কনভেনশনে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন সাবেক দুই সংসদ সদস্য সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও খাদিজাতুল আনোয়ার সনি। তাদের উপস্থিতির খবর রটিয়ে দিয়ে কনভেনশন সেন্টারে জড়ো হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীরা। রাত পৌনে ১১টায় তারা ঘেরাও করেন কনভেনশন সেন্টার। এ সময় সেখানে হাজির হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। খবরটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কনভেনশন সেন্টার এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা জড়ো হয়ে ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’ স্লোগান দিতে থাকেন। এই ভিডিওতে দেখা গেছে, জড়ো হওয়া তরুণেরা কয়েকজনকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করতে থাকেন। এই সময় চারপাশ থেকে স্লোগান দিতে থাকেন লোকজন।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন সদস্য কনভেনশন সেন্টারের ভেতরে থাকা ৩-৪ জন তরুণকে লাঠিপেটা করছে। এ সময় কিল–ঘুষিও মারতে দেখা যায়। এতে এক তরুণের পরনের পোশাক ছিঁড়ে যায়। তাদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতেও দেখা যায়।

তবে এ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোকে দেয়া বক্তব্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন। জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতারা স্বাধীনভাবে সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন, চলাফেরা করবেন, ছাত্র-জনতা তা মেনে নেবেন না। তাই ওদের আটকের দাবিতে কনভেনশন সেন্টার ঘেরাও করা হয়েছে। ফখরুল আনোয়ারকে আটক করতে পারলেও অন্য দুজন পালিয়ে গেছেন। তারা ভোর পাঁচটা পর্যন্ত সেখানে ছিলেন বলেও জানান তিনি।

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. লিয়াকত আলীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি চাটগাঁ নিউজকে বলেন, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে হয়তো এমনটা ঘটানো হয়েছে। তবে এসমস্ত ঘটনা সমাজে তেমন প্রভাব ফেলবে না। এগুলো ক্ষণস্থায়ী ঘটনা। দেশে স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা আসলে এগুলো আর ঘটবে না। তবে এ ব্যাপারে আমাদেরকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে।

ফখরুল আনোয়ারকে আটক ও  রিমান্ড

গত শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাতে ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা ফখরুল আনোয়ারকে (৫৮) আটক করা হয়। পরদিন রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) তাকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে চট্টগ্রামের ৬ষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হলে শুনানি শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আওয়ামী লীগ নেতা ফখরুল আনোয়ারকে তৃতীয় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর হোসেনের আদালতে হাজির করে কোতোয়ালি পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত ফখরুল আনোয়ারের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

চাটগাঁ নিউজ/ইউডি/এসএ

Scroll to Top