উজ্জ্বল দত্ত : নিজেদের অপরাধ বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত শিবিরের অনেক নেতাকর্মী এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে অনুপ্রবেশ করছেন। ৫ আগষ্ট পরবর্তী এরা বিএনপিতে অনুপ্রবেশ করে দলীয় নেতাকর্মীদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ঘটিয়ে চলেছেন সংঘর্ষ, হামলা, হত্যাসহ নানা অপকর্ম। এতে করে চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে আস্থা হারাচ্ছে বিএনপি।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ মাসে চট্টগ্রামে ইট-বালির ব্যবসা, টেম্পু স্টেশন ব্যবসা, ফুটপাত বাণিজ্য, টার্ফ ব্যবসা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি-লুটের ঘটনায় সৃষ্ট হামলা, সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হয়েছেন। তবে এই ৫ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত আসামিরা বিএনপির কর্মী বলে পরিচিতি পেলেও তারা অন্য দল থেকে বিএনপিতে অনুপ্রবেশ করেছে বলে দাবি করছে বিএনপি।
গত ২৯ আগস্ট রাতে বায়েজিদ থানাধীন অনন্যা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন নাহার গার্ডেনের সামনে মোটরসাইকেলে করে এসে পাঁচ যুবক এক আওয়ামী লীগ নেতাসহ দুজনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে চট্টগ্রাম ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আনিস (৩৮) নিহত হন। তাঁর সঙ্গে থাকা যুবলীগ কর্মী মাসুদ কায়ছার (৩২) তাৎক্ষণিক পালিয়ে যেতে পারলেও কয়েকশ গজ দূরে হাটহাজারী থানা কুয়াইশ এলাকায় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই জোড়া খুনের ঘটনায় করা দুটি মামলাতেই এজাহারনামীয় আসামি সাজ্জাদ হোসেন (ছোট সাজ্জাদ)।
এর কিছুদিন পর ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার অদুরপাড়ায় সন্ত্রাসীরা ইট-বালুর ব্যবসা ও বহদ্দারহাট-শমসের পাড়া টেম্পু স্টেশন দখল নিয়ে ছাত্রলীগের কর্মী আফতাব উদ্দিন তাহসিনকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় করা মামলাতেও আসামি ওই ছোট সাজ্জাদ। এই তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই ঘটেছে মূলত শিবির কর্মী ছোট সাজ্জাদ ও সরোয়ার হোসেন বাবলার মধ্যে ইট বালুর ব্যবসা ও এলাকার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রিক।
এই ছোট সাজ্জাদ নিজেকে হাটহাজারী চিকনদণ্ডি ইউনিয়ন যুবদলের কর্মী বলে পরিচিতি দিলেও তিনি এইট মার্ডার হত্যা মামলার আলোচিত শিবির কর্মী সাজ্জাদ আলী খানের অনুসারী ছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের অনুসারী। ৫ আগস্টের কয়েক মাস আগে ও পরে তিনি বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয়। মীর হেলালের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ছোট সাজ্জাদের একাধিক ছবিও পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে মীর হেলাল বলেন, সন্ত্রাসীদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। যেকোন ধরণের সন্ত্রাসী অপকর্মে যারাই জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দলীয় হাইকমান্ড থেকে প্রশাসনের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে। সাজ্জাদ আমাদের দলের কোন কর্মী নয়। অনেকে বিএনপি যুবদল, ছাত্রদলের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছে।
এদিকে, পাঁচলাইশ, চাইল্যাতলী, ওয়াজেদিয়াসহ আতুরার ডিপো ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শিবির কর্মী সরওয়ার এখন সক্রিয় অবস্থানে রয়েছেন। আতুরার ডিপো মোড়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর ছবি ব্যবহার করে তিনি একটি ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছেন।
২০ সেপ্টেম্বর বিকালে চান্দগাঁও ওয়ার্ড কার্যালয় সংলগ্ন চান্দগাঁও স্পোর্টস জোন নামে একটি টার্ফের ব্যবসা দখল নিয়ে নগর যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মোশাররফ হোসাইন ও সাবেক কৃষি বিষয়ক সম্পাদক নুরুল আমিনের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে জুবায়ের উদ্দিন বাবু নামে এক কর্মী নিহত হন।
তবে নিহত জুবায়ের যুবদল নেতা মোশাররফের কর্মী হিসেবে সংঘর্ষে নিহত হলেও তার বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহেদের দাবি, নিহত বাবু যুবদলের কর্মী নন। তিনি যুবলীগের কর্মী। বাবুর ফেসবুকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে ছবি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমের ছবি রয়েছে। যুবলীগের কর্মীকে দলে এনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন মোশাররফ।
২৮ অক্টোবর রাতে দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ড এলাকার বাস্তুহারা কলোনি এলাকায় দোকানের মালামাল লুট করতে যায় স্থানীয় বিএনপির একটি গ্রুপ। এতে বাধা দিতে গিয়ে হামলার শিকার হন নূর আলম নামে এক বিএনপি নেতা। গুরুতর আহত অবস্থায় নগরীর একটি হাসপাতালে চারদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২ নভেম্বর শনিবার তিনি মারা যান। তিনি দক্ষিণ আগ্রাবাদ বাস্তুহারা ইউনিট কমিটির বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও ২৭ নং ওয়ার্ড বিএনপির নেতা ছিলেন।
এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ব্যাপারেও তীর যাচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের দিকে। নিহতের পরিবার ও স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দাবি, নব্য বিএনপি কর্মী সেজে এলাকার দোকানের মালামাল লুট করতে যায় ২০ জন আওয়ামী সন্ত্রাসীদের একটি দল। এতে বাধা দিতে গেলে রাতের আঁধারে নূর আলমের মাথায় আঘাত করেন আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ভোগ দখলের প্রতিবাদ করায় পরিকল্পিতভাবে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে তাকে।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম সিটির নব্য মেয়র নগর বিএনপির সাবেক আহবায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা অন্তরালে চলে গেলেও তৃণমূল নেতাকর্মীরা লুকাতে পারছেন না। তারা আমাদের দলের নেতাকর্মীদের সাথে মিলেমিশে নানা অপকর্ম ঘটিয়ে চলেছেন। এই ব্যাপারে প্রশাসনকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। দলীয় কর্মীরা শাস্তি পাচ্ছে। দল থেকে বহিস্কৃত হচ্ছে। কিন্তু বহিরাগতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ