বান্দরবানে শিক্ষক সংকটে ধুঁকছে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা

মোহাম্মদ ইলিয়াছ: বান্দরবান পার্বত্য জেলায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। জেলার ৪৩৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৭৯টিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক নেই। এতে বিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক দুর্বলতা ও পাঠদানে বড় ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকেরও ৪২টি পদ শূন্য রয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদে সহকারী শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে একসঙ্গে প্রশাসনিক কাজ ও পাঠদান সামলাতে গিয়ে শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশেষ করে রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি ও আলীকদম উপজেলায় সংকট আরও তীব্র। সরেজমিনে দেখা গেছে—স্কুলে দপ্তরি নেই, ফলে প্রধান শিক্ষক ও শ্রেণী শিক্ষকরাই দপ্তরির দায়িত্ব পালন করছেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে ঘণ্টা বাজানো পর্যন্ত সব কাজ করতে হচ্ছে শিক্ষকদের।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, অভিজ্ঞ শিক্ষকদের পদোন্নতি না হওয়ায় নবীন শিক্ষকরাই প্রধানের দায়িত্বে আছেন। ২০২২-২৩ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত অনভিজ্ঞ শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে কাজ করায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা শিশুর জীবনের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এখানেই ঘাটতি হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

শুধু শিক্ষক নয়, শিক্ষা প্রশাসনেও সংকট ভয়াবহ। উপজেলায় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ইউইও) থাকার কথা ৭ জন, কর্মরত আছেন মাত্র ৩ জন। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার (এটিইও) থাকার কথা ১৪ জন, কর্মরত আছেন মাত্র ৩ জন। অর্থাৎ ১১টি পদ শূন্য। জেলা পর্যায়ে সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (এডিপিইও) ২টি পদের মধ্যে আছেন মাত্র একজন। অর্থাৎ শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষক মিলে পুরো বান্দরবানে মোট ২৩৭টি পদ শূন্য হয়ে পড়ে আছে।

১৯৮৬ সালে বান্দরবানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ২১৯টি। সে সময়ের জনবল কাঠামো দিয়েই এখনো শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে। অথচ ৪০ বছরে নতুন করে আরও ২১৬টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ হলেও শিক্ষা কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়ানো হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিন শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তার শূন্যপদ পূরণ না হলে প্রাথমিক শিক্ষার হার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। তাই দ্রুত নিয়োগ ও পদোন্নতি সম্পন্ন করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

রুমা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আশীষ চিরান জানান, উপজেলায় ৬৮টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৪টিতেই প্রধান শিক্ষক শূন্য। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

বান্দরবান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. মোফাজ্জল হোসেন খান বলেন, জেলায় প্রধান শিক্ষকের ১৭৯টি পদ শূন্য। সহকারী শিক্ষকের ২০৩৯টি পদের মধ্যে ৪২টি শূন্য। সহকারী শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে। তবে প্রধান শিক্ষক নিয়োগে ৬৫ শতাংশ পদোন্নতি ও ৩৫ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ হওয়ার কথা। সহকারী শিক্ষক বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে পারলেও প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেন না। তবে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি আশা করছেন, অতিদ্রুত এই অচলাবস্থা কেটে যাবে।

তিনি আরও জানান, ঝরে পড়া রোধে দুর্গম এলাকায় আবাসিক পদ্ধতিতে আরও ৪৮টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থার কথাও ভাবা হচ্ছে, বলে জানান তিনি।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের ন্যস্ত বিভাগ, যেহেতু বান্দরবান শিক্ষায় পিছিয়ে আছে, সে লক্ষেই কাজ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে ৪২টি সহকারী শিক্ষকের শূন্যপদে নিয়োগের জন্য ছাড়পত্র পাওয়া গেছে; অতিশীঘ্রই সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। আর প্রধান শিক্ষক যেহেতু দ্বিতীয় শ্রেণী করা হয়েছে, সহকারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ করা হবে, তাই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে, বলে জানান তিনি।

চাটগাঁ নিউজ/এমকেএন

Scroll to Top