উজ্জ্বল দত্ত : অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বকালীন ২ মাস ২০ দিন সময়ে চট্টগ্রাম নগরীতে সাত সাতটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার আমলে জেলে থাকা আসামিরা জামিনে বের হয়ে জবর দখল, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, জোরপূর্বক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল, চাঁদার ভাগ বাটোয়ারাসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। এরাই জড়িত এই সময়ের সংঘটিত একের পর এক হত্যাকাণ্ডে। এসবের মধ্যে একটি পারিবারিক আর বাকি ছয়টি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে।
পর পর ঘটে যাওয়া সাতটি মার্ডার মামলার সত্য উদঘাটন করতে গিয়ে পুলিশের কাছে এমন তথ্য উঠে এসেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দিনরাত কাজ করেও ইতিবাচক অগ্রগতি পাচ্ছে না পুলিশ। রীতিমত ভেঙ্গে পড়তে চলেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা। সিরিয়াল কিলিংয়ের এমন ঘটনায় জনমনে বিরাজ করছে আতঙ্ক আর শঙ্কা। জনআস্থা অক্ষুন্ন রাখতে ও অস্তিত্ব জানান দিতে কয়েকজনকে গ্রেফতার দেখালেও হত্যাকাণ্ডে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি সংস্থাটি।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আব্দুল মান্নান মিয়া বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ তড়িৎ গতিতে কাজ করছে। জড়িতদেরকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। প্রযুক্তির সহায়তার আসামিদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
২১ অক্টোবর সোমবার বিকেল সোয়া ৪টার দিকে নগরের চান্দগাঁও থানার শমসেরপাড়া উদুর পাড়া এলাকায় ইট-বালির ব্যবসা দখল নেওয়াকে কেন্দ্র করে একদল চিহ্নিত সন্ত্রাসীর গুলিতে আফতার উদ্দিন তাহসিন নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। আফতাব উদ্দিন ওমরগণি এমইএস কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি ভাইয়ের ইট-বালির ব্যবসায় তিনি সহযোগিতা করতেন। এই ঘটনায় জামায়াত শিবিরের ক্যাডার সাজ্জাদ তার সহযোগী হাছান, মাহমুদসহ চারজনের নাম উঠে আসে পুলিশের কাছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্ত সাজ্জাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির ১০টি মামলা রয়েছে। গত ১৭ জুলাই চান্দগাঁও থানা-পুলিশ অস্ত্রসহ সাজ্জাদকে গ্রেফতার করে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগে সাজ্জাদ আগষ্ট মাসে ঢালাও জামিনে বেরিয়ে আসে। নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন অক্সিজেন অনন্যা আবাসিক, শীতলঝর্ণা, কালারপুল, হাটহাজারীর কুয়াইশ, চান্দগাঁও হাজীরপুল ও পাঁচলাইশ এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণে সাজ্জাদের বাহিনী নানা এসব অপকর্ম চালাচ্ছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনের পাঁচ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে সাজ্জাদ তার সহযোগীদের নিয়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটান। সিসিটিভি ফুটেজের গুলি করার ঘটনা ধারণ করা থাকলেও ভয়ে ভবন মালিকেরা কেউ মামলা করেননি।
গত ২৯ আগস্ট বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার অক্সিজেন-কুয়াইশ অনন্যা আবাসিক এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাসুদ কায়সার ও মোহাম্মদ আনিস নামে দুই যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দুটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশের ধারণা, সাজ্জাদ ও তার দলের লোকজনই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
গত ২১ সেপ্টেম্বর বিকালে চান্দগাঁও থানার ওয়ার্ড অফিস সংলগ্ন এলাকায় টার্ফ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে মহানগর যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মোশাররফ হোসেন গ্রুপের সঙ্গে বিএনপি নেতা আমিন গ্রুপের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে জুবায়ের উদ্দিন বাবু (২৬) নামে একজন নিহত হন।
১১ অক্টোবর রাতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার বার্মা কলোনির মো. সবুজ ও তার ভাই ছাত্রদল নেতা সাইফুলের সঙ্গে কৃষক দল নেতা শাহ আলমের অনুসারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে সবুজের অনুসারী মো. ইমন নিহত হন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বার্মা কলোনি, শান্তি কলোনিসহ আশপাশের এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও রেলের জায়গা দখলে নিতেই এই সংঘর্ষ বাঁধে। তাছাড়া গত ২৫ সেপ্টেম্বর নগরের খুলশী থানার কর্ণফুলী মার্কেট এলাকায় রেললাইনে দোকান বসানো নিয়ে আলাউদ্দিন ও রাশেদ নামে দুজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখমেরও অভিযোগ ওঠে এই ছাত্রদল নেতা সাইফুলের বিরুদ্ধে।
১৪ আগস্ট নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকায় ফ্লাইওভারের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে শাহাদাত হোসেন নামে এক যুবককে গান গেয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত বালি ব্যবসায়ী ফরহাদ আহমেদ চৌধুরী ‘ছাত্র জনতা ট্রাফিক গ্রুপ’ নামে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে দলবল নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটান।
হত্যাকাণ্ড মামলাগুলোর অগ্রগতি নিয়ে অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল মান্নান মিয়া আরও বলেন, বায়েজিদে খুনের ঘটনায় জড়িতদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ‘মধু হই হই’ গান গেয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদেরকে গ্রেফতারে আমাদের টিম রাতদিন কাজ করছে। একটু সময় লাগছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের জিরো টলারেন্স।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ