বাকলিয়ায় জোড়া খুন— নেপথ্যে বালু মহাল, আধিপত্য বিস্তার ও ছোট সাজ্জাদ

চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক: মধ্যরাতে চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া এক্সেস রোডের মুখে একটি প্রাইভেট কারকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে জোড়া খুন করা হয়েছে। যার নেপথ্যে রয়েছে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবৈধ বালুমহাল দখল, সরকারি জমি দখল ও পূর্ব শত্রুতার জেরে আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি রয়েছে ছোট সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেয়ার প্রতিশোধ।

শনিবার (২৯ মার্চ) দিবাগত রাত পৌনে ৩টার দিকে নগরীর নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা সড়কের চন্দনপুরায় বাকলিয়া এক্সেস রোডের মুখে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

নিহত দু’জন হলেন— প্রাইভেট কারের মালিক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ (৩৬) ও চালক বখতেয়ার উদ্দিন মানিক (৩২)। আবদুল্লাহর বাড়ি কক্সবাজারে আর মানিকের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। তবে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার শেরশাহ এলাকায় থাকতেন তারা।

অন্যদিকে আহতরা হলেন— মো. রবিন ও মো. হৃদয়। তারা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের বাসাও নগরীর শেরশাহ এলাকায়।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, শনিবার রাত থেকেই কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু এলাকায় বালু মহালের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অবস্থান করছিলো সন্ত্রাসীদের দুটি গ্রুপ। এর মধ্যে চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী সারোয়ার বাবলার নেতৃত্বে একটি প্রাইভেটকারে ছিলেন নিহত মানিক, আবদুল্লাহ, ইমন এবং রবিনসহ ৬ জন।

আরেকটি গ্রুপে খোরশেদ হাসানের নেতৃত্বে ছিলেন হাসান, রায়হানসহ আরও কয়েকজন। তাদের কাছে ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্র। মূলত রাউজান-রাঙ্গুনিয়া কেন্দ্রীক ‘ডন’ হিসেবেই পরিচিত তারা। রাঙ্গুনিয়া-রাউজানে সম্প্রতি সংগঠিত হত্যাকাণ্ড ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে তাদের ইন্ধন রয়েছে বলেও জানা যায়।

সিএমপি উত্তর জোনের উপ-কমিশনার আমিরুল ইসলাম বলেন, বালু মহালকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী সারোয়ার বাবলার সাথে সন্ত্রাসী খোরশেদ, রায়হান এবং হাসানের গ্রুপের আগে থেকে দ্বন্দ্ব ছিল। আজ (শনিবার) বাবলা গ্রুপ ৬ জন নিয়ে একটি প্রাইভেটকারে ছিল। চার-পাঁচটি মোটরসাইকেল নিয়ে খোরশেদ গ্রুপ তাদের রাজাখালী ব্রিজ থেকে ধাওয়া করে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক গোলাগুলি হয়েছে। তাদের উভয়ের কাছে ভারী অস্ত্র ছিল।

তিনি আরো বলেন, চন্দনপুরা এলাকায় পুলিশের টহল গাড়ি দেখে সারোয়ার গ্রুপের একজন সাহায্য চাইতে যায়। এর মধ্যে মোটরসাইকেলে এসে অন্য গ্রুপ প্রাইভেটকার লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই দুজনের মৃত্যু হয় এবং গুলিবিদ্ধ হন আরও দুজন। ইমন নামে একজন পুলিশ হেফাজতে আছে। সারোয়ার বাবলা ওই সময় পালিয়ে যায়।

এদিকে সারোয়ার বাবলার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,  চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর এইট মার্ডার মামলার আসামি শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ আলী খানের একসময়ের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ ছিল সারোয়ার হোসেন বাবলা। তিনি নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার খোন্দকার পাড়ার কালা মুন্সির বাড়ির আব্দুল কাদেরের ছেলে। চার বছর জেল খেটে পালিয়ে যান ভারতে। সেখানে পালিয়ে থাকা ‘বড়ভাই’ সাজ্জাদের দেখভালোর দায়িত্বে ছিলেন।

২০২০ সালে দেশে ফিরেই গ্রেপ্তার হন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। পরে বের হয়ে চার বছর পালিয়ে ফের গ্রেপ্তার হন ২০২৪ সালের জুলাইয়ে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, নগরের ডবলমুরিং, পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ বোস্তামি থানায় হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে মোট ১৮টি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সবগুলোতে জামিনে রয়েছেন তিনি।

সবশেষ গত বছরের ২৭ জুলাই সারোয়ারকে গ্রেপ্তার করেছিল চান্দগাঁও থানা পুলিশ। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে পুনরায় জড়িয়ে পড়েন  অপকর্মে।

ছোট সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রতিশোধ

নিহতদের স্বজন ও আহতদের সাথে কথা বলে জানা গেছে— কর্ণফুলী নদীর বালুমহাল নিয়ে বিরোধের পাশাপাশি ছোট সাজ্জাদকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যও এ হত্যাকাণ্ড। ছোট সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেয়ার পেছনে সারোয়ার বাবলা ও আবদুল্লাহকে সন্দেহ করে আসছিল ছোট সাজ্জাদের অনুসারীরা। সন্দেহের জেরে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে আভাস মিলেছে। তবে পুলিশ তদন্তের আগে এ বিষয়ে কিছুই বলছে না।

নিহত আবদুল্লাহর মা ও স্ত্রী জানান, বর্তমানে কারাবন্দী ছোট সাজ্জাদ দুই মাসে আগে আবদুল্লাহকে পায়ে গুলি করে আহত করেছিল। সাজ্জাদের প্রতিপক্ষ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সারোয়ার হোসেন বাবলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় আবদুল্লাহ তার রোষানলে ছিল। প্রাইভেট কারে থাকা সারোয়ার ও আবদুল্লাহকে টার্গেট করা হয়েছিল বলে তাদের দাবি।

আবদুল্লাহর স্ত্রী পিয়ামণি বলেন, সাজ্জাদ গ্রুপের লোকজন আমার স্বামীকে খুন করেছে। আবদুল্লাহ কেন সারোয়ারের সাথে থাকে, তার সাথে কথা বলে, এজন্য সাজ্জাদের খুব রাগ। আবদুল্লাহকে পায়ে গুলিও করেছিল। আমাদের ধারণা, সরোয়ারকে মারতে হামলা করেছিল সাজ্জাদের লোকজন। আবদুল্লাহও তাদের টার্গেট ছিল।

তিনি আরো জানান, শনিবার সকাল ৯টার দিকে আবদুল্লাহ বাসা থেকে বের হন। সন্ধ্যায় বাসায় ইফতার করার কথা থাকলেও যাননি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার স্ত্রীকে ফোন করে নিউমার্কেট গিয়ে কেনাকাটার জন্য টাকা দিয়ে আসতে বলেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে পিয়ামণি এক লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়ে নিউমার্কেট গিয়ে স্বামীর হাতে দেন।

তখন আবদুল্লাহ বলল— সারোয়ার ভাই ফোন করেছেন, আমি নতুন ব্রিজ যাচ্ছি। রাত ২টার দিকে আমি তাকে ভিডিও কল দিই। দেখি, সেখানে একটি বালুর টালের মাঝে সারোয়ার ভাই বসে কথা বলছেন। এরপর থেকে তার মোবাইল বন্ধ পাই। সকালে রবিন আমাকে তার মারা যাবার খবর জানায়।

চকবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. জাহেদুল কবীর বলেন, আমরা তদন্ত শুরু করেছি। তদন্তের আগে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। আমরা অপরাধীদের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি।

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) শাকিলা সুলতানা বলেন— আমরা তদন্ত চালাচ্ছি। ঘটনাস্থল থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ মার্ডারের নেপথ্য কারণ কি। কারা জড়িত সে ব্যাপারে প্রযুক্তি সহায়তায় ঘটনা বিশ্লেষন চলছে। সরোয়ার-ছোট সাজ্জাদের বিরোধ নাকি তাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যবসা সংক্রান্ত সব বিষয় সামনে রেখে তদন্ত চলছে।

চাটগাঁ নিউজ/জেএইচ

Scroll to Top