মাহদি হাসান সাবেরি, অতিথি লেখক: ইতিহাসের পাতায় ১৭ রমজান এক অবিস্মরণীয় দিন, এই দিনে মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল। বদর যুদ্ধ কোনো সাধারণ যুদ্ধ ছিল না; এটি ছিল সত্য-মিথ্যার চূড়ান্ত পরীক্ষা, ঈমান ও কুফরের মধ্যকার প্রথম মুখোমুখি সংঘর্ষ। এ যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। এ মহান বিজয় ইসলামের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস ও ঈমানকে মজবুত করে তোলে।
রাসুল (সা.)-এর এই দোয়া থেকেই স্পষ্ট হয়, বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট কতটা ভয়াবহ ছিল! মহান আল্লাহ দয়া করে সেদিন ফেরেশতাদের মাধ্যমে মুমিনদের সাহায্য করেছিলেন। যদিও এটি ক্ষুদ্র একটি যুদ্ধ ছিল, কিন্তু এর প্রভাবে বিশ্বের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যায়। যারা একদিন আগেও ইসলামের অগ্রযাত্রা রোধ করাকে সহজ মনে করেছিল, তারা বুঝতে পেরেছে যে ইসলামের এ অগ্রযাত্রা রোধ করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভবও বটে।
বদর যুদ্ধের পটভূমি
হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষ, ১৭ রমজান। মুসলমানদের নবগঠিত রাষ্ট্র মদীনা তখনো ছিল অস্থিতিশীল। মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের নির্মূল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, মদীনা ইসলামের একটি শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হচ্ছে, যা তাদের জন্য হুমকি।
হিজরতের পরও কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, মুসলমানদের সম্পদ লুট, তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার অব্যাহত রেখেছিল।
কুরাইশদের নেতা আবু সুফিয়ান একটি বিশাল ব্যবসায়িক কাফেলা পরিচালনা করে সিরিয়া থেকে প্রচুর সম্পদ নিয়ে ফিরছিলেন। কুরাইশদের দুর্বল করতে ও মুসলমানদের প্রতি তাদের দমননীতি বন্ধ করতে বাধ্য করতে মহানবী সা. এই কাফেলা আটকে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। আবু সুফিয়ান এই পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরে মক্কায় খবর পাঠিয়ে এক হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করে মুসলমানদের নির্মূল করতে বদরের দিকে অগ্রসর হয়।
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী কুরাইশদের প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিলেন। মুসলিম বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন আলি ইবনে আবি তালিব, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, আবু বকর, উমর ইবনুল খাত্তাব, মুসআব ইবনে উমাইর, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আম্মার ইবনে ইয়াসির, আবু যার আল-গিফারী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)।
উসমান ইবনে আফফান (রা.) স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে এই যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। সালমান ফারসি (রা.) তখনও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকায় যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হতে পারেননি।
এই বাহিনীতে মোট ৩১৩ জন মুজাহিদ ছিলেন। তাদের মধ্যে মুহাজির ছিলেন ৮২ জন, আওস গোত্রের ৬১ জন আনসার, খাজরাজ গোত্রের ১৭০ জন আনসার সাহাবি ছিলেন। তাদের যুদ্ধসজ্জা ছিল সীমিত—মাত্র ৭০টি উট, দুটি ঘোড়া। ফলে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে তাদের কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল। পায়ে হেঁটে চলতে হয়েছে। আবার প্রতি দুই বা তিনজনের জন্য একটি উট ভাগ করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
মহানবী (সা.), আলি ইবনে আবি তালিব (রা.), মারসাদ ইবনে আবি মারসাদ (রা.) পালাক্রমে একটি উট ব্যবহার করেছিলেন।
এই ঐতিহাসিক অভিযানের সার্বিক নেতৃত্বের ভার ছিল মহানবী (সা.)-এর হাতে। মুসলিম বাহিনীর সম্মানের প্রতীক হিসেবে তিনি মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-কে একটি সাদা পতাকা প্রদান করেন। কালো রঙের একটি পতাকা মুহাজিরদের পক্ষ থেকে আলি ইবনে আবি তালিব (রা.)-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। আনসারদের পতাকা সাদ ইবনে মুয়াজ (রা.) বহন করেছিলেন।
বাহিনীর কৌশলগত বিভাগেও সূক্ষ্ম পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল—ডান পাশের নেতৃত্বে ছিলেন যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.), বাম পাশের দায়িত্বে ছিলেন মিকদাদ ইবনে আমর (রা.), যাঁরা মুসলিম বাহিনীর একমাত্র দুটি ঘোড়ার উপর আরোহণ করেছিলেন। পেছনের অংশের নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছিল কাইস ইবনে আবি (রা.)-কে।
এই বাহিনী ছিল ক্ষুদ্র কিন্তু অদম্য, তাদের ছিল সীমিত সরঞ্জাম, কিন্তু হৃদয়ে ছিল ঈমানের আগুন। প্রতিটি পদক্ষেপে তারা ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছিলেন, আর তাদের সামনে ছিল এক মহান বিজয়ের প্রতিশ্রুতি। নবিজী (সা.)-এর নেতৃত্বে এই যাত্রা শুধু একটি যুদ্ধাভিযান ছিল না, এটি ছিল সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যার আলো যুগে যুগে ছড়িয়ে পড়েছে মানবতার প্রাঙ্গণে।
বদর যুদ্ধ শুরু ও মহান আল্লাহর সাহায্য
যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতে তুলে নেন দোয়ার হাতিয়ার। তিনি আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করেন—
হে আল্লাহ! যদি আজ এই দলটি (মুসলিম বাহিনী) পরাজিত হয়, তবে পৃথিবীতে তোমার ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না! (মুসলিম, হাদিস: ১৭৬৩)
এই দোয়ার পর আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের মাধ্যমে মুসলমানদের সাহায্য করেন। কোরআনে এসেছে—
যখন তোমরা তোমাদের রবের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলে, তখন তিনি তোমাদের দোয়া কবুল করেছিলেন, বলেছিলেন, আমি এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করব, যারা পর্যায়ক্রমে আসবে। (সূরা আনফাল, আয়াত : ৯)
এরপর মুসলমানরা অদম্য সাহস নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
বিজয়ের মুহূর্ত
মুসলমানদের ঈমানী শক্তি, নবীজীর দোয়া, ফেরেশতাদের সহায়তা, সাহাবাদের আত্মত্যাগের ফলে বদর যুদ্ধ এক ঐতিহাসিক বিজয়ে রূপ নেয়। কুরাইশ নেতা আবু জাহেল-সহ কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। ৭০ জনকে বন্দি করা হয়। মুসলমানদের শহীদ হন মাত্র ১৪ জন। এই বিজয় শুধু সংখ্যাগত ছিল না; এটি ছিল ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের জন্য এক মহান বিজয়।
বদর যুদ্ধের শিক্ষা
আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা : আল্লাহর ওপর ঈমান ও তাকওয়ার ওপর অবিচল থাকলে ছোট একটি বাহিনী বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করতে পারে।
নবীজীর দোয়ার শক্তি : বদরের ময়দানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দোয়া কবুল হওয়া ছিল মুসলমানদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা।
আল্লাহর রহমত : সংখ্যাধিক্যের বড়াইয়ের পরিবর্তে আল্লাহর রহমত ও করুণাই মুমিনের জীবনের পরম হাতিয়ার।
চাটগাঁ নিউজ/এমকেএন