প্রাথমিক স্কুলে ৭৮৩৮০ পদ শূন্য, একসঙ্গে নিয়োগের চিন্তা

চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৭৮ হাজার ৩৮০টি শিক্ষক পদ ফাঁকা রয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এ শূন্যতা শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ব্যাহত করছে না, প্রভাব ফেলছে শিশুদের শেখার আগ্রহ, শিক্ষার মান এবং ভবিষ্যৎ প্রস্তুতির ওপরও। তবে সরকার বলছে, সব শূন্য পদে একসঙ্গে নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে রয়েছে আইনি, প্রশাসনিক ও নীতিগত একাধিক জটিলতা।

ইতোমধ্যে এসব শূন্য পদ নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১৫ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। বৈঠকে দেশের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সংকট এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

প্রধান উপদেষ্টা এ সময় নির্দেশনা দেন, আর বিলম্ব না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব শূন্য পদে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করতে হবে।

এসময় উপস্থিত ছিলেন মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানা ও অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আকতার খান।

অন্যদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৭টি। বিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষক পদের সংখ্যা চার লাখ ২২ হাজার ১১০টি। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষক পদ রয়েছে ৬৫ হাজার ৪৫৭টি। এগুলোর মধ্যে ৩৪ হাজার ১০৬টি পদ এখনও শূন্য পড়ে আছে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক স্কুলই প্রধান শিক্ষক ছাড়া চলছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষকরা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যা শিক্ষার গুণগত মানে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

আবার সহকারী শিক্ষক পদের চিত্রটিও বেশ উদ্বেগজনক। তিন লাখ ৫৫ হাজার ৬৫৩টি সহকারী শিক্ষক পদের মধ্যে ২৪ হাজার ৫৩৬টি এখনও পূরণ হয়নি। এ দুই ধরনের শূন্য পদের পাশাপাশি আরও নতুন কিছু পদ সৃষ্টির কাজও চলছে। এর মধ্যে নয় হাজার ৫৭২টি সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসব পদ সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হতে পারে। এছাড়া শারীরিক ও সংগীত শিক্ষার জন্য পাঁচ হাজার ১৬৬টি এবং চারুকলার জন্য প্রায় পাঁচ হাজার নতুন শিক্ষক পদ তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার পেছনে একাধিক প্রশাসনিক ও আইনি জটিলতা রয়েছে। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক পদের মর্যাদা সংক্রান্ত মামলা বর্তমানে উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। বর্তমান নিয়মে প্রধান শিক্ষকরা পাচ্ছেন ১১তম গ্রেড, অথচ ৪৫ জন রিটকারী শিক্ষককে দেওয়া হয়েছে দশম গ্রেড এবং দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদা। অর্থ মন্ত্রণালয় কেবল ওই ৪৫ জনের জন্যই এ সুবিধা কার্যকর করেছে। এটি নিয়ে দেশের অন্যান্য প্রধান শিক্ষকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা একযোগে মামলা কিংবা কর্মসূচিতে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।

একইসঙ্গে নিয়োগে আরেকটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘কোটা’ সংক্রান্ত বিষয়। বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী প্রার্থীদের জন্য ৬০ শতাংশ কোটা চালু আছে। তবে, গত বছরের একটি রায়ে উচ্চ আদালত চাকরিতে নয় শতাংশ মেধাভিত্তিক নিয়োগের নির্দেশ দেয়। ফলে এ নতুন নির্দেশনা নিয়োগবিধিতে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে, তা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতামতের অপেক্ষায় রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সরকারি সূত্র জানায়, প্রধান শিক্ষক পদের মর্যাদা নিয়ে চলমান মামলাটি এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত চূড়ান্ত নিয়োগ কাঠামো নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। আবার কোটা ইস্যুতে একদিকে রয়েছে উচ্চ আদালতের রায়, অন্যদিকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। দুটি দিক সামঞ্জস্য করা না গেলে বিপত্তি ঘটতে পারে বলেও মনে করেন তিনি৷

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিদ্যালয়) মাসুদ আকতার বলেন, আমরা চাচ্ছি সব শূন্য পদের জন্য একসঙ্গে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে। এতে সময় বাঁচবে, প্রক্রিয়াও হবে স্বচ্ছ। এখন কেবল কোটা ও আদালতের মতামতের জন্য অপেক্ষা করছি।

এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক কোটির বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এই বিপুল শিক্ষার্থীর জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে একাধিক শ্রেণি একত্রে পরিচালনার ক্ষেত্রে তীব্র সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অনেক শিক্ষক।

এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বড় পরিসরে দ্রুত নিয়োগ না দিলে প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার মান রক্ষা করতে হলে নিয়মিতভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আমি মনে করি, পদ শূন্য হওয়ার ছয় মাস আগেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়া উচিত।

সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্বে থাকা প্রশাসন বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে, শিক্ষক সংকট কেবল শিক্ষার মানকেই প্রভাবিত করছে না; এর প্রভাব শিশুদের উপস্থিতি, শৃঙ্খলা, বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পিইসি পরীক্ষার ফলাফলেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করতে হলে আদালতের রায় অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক পদের মর্যাদা নির্ধারণ, কোটা ব্যবস্থা হালনাগাদ এবং নিয়োগ বিধিমালার সংশোধন একযোগে সম্পন্ন করতে হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কাজ চলমান রয়েছে এবং এ মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত মতামত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এরপরই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দিকে যাবে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, এবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হলে তা হবে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নিয়োগ কার্যক্রম। এতে একদিকে যেমন হাজার হাজার বেকার শিক্ষিত যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানেও আশানুরূপ অগ্রগতি আসবে।

তবে, শিক্ষা খাতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও উচ্চশিক্ষার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষাবিদরাও মনে করছেন, শিক্ষক সংকট শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সক্ষমতা ও সম্ভাবনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।

চাটগাঁ নিউজ/এসএ

Scroll to Top