সিপ্লাস ডেস্ক: কয়েকদিনের টানা বর্ষণে ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত বান্দরবান শহর এখন বিচ্ছিন্ন। লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে পানিতে। বান্দরবান থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও কক্সবাজারগামী দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া জেলা শহর থেকে রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কেও কয়েক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল। এছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক ডুবে গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
বান্দরবানে পাহাড় ধসে মা–মেয়েসহ ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। লামায় দেয়াল ধসে একজন মারা গেছেন। নাইক্ষ্যংছড়িতে ২ জন এবং সাতকানিয়ায় ৪ জন নিখোঁজ রয়েছেন। বন্যার্তদের সহযোগিতায় বান্দরবান, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বান্দরবানে ছয়দিন ধরে অবিরাম বর্ষণে কালাঘাটা গুদারপাড় এলাকায় পাহাড় ধসে মা–মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন নূর নাহার (৪২) ও সাবুকননেছা (১৪)। আলীকদমে বন্যায় ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়া পানিতে ভেসে নাইক্ষ্যংছড়িতে ম্রো সম্প্রদায়ের ১ জন ও টংকাবতীতে ১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। পানিতে তলিয়ে যাওয়া ছাত্রাবাস থেকে ৩৪ জন শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। দুর্যোগ পরিস্থিত মোকাবেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বিদ্যুতের সাবস্টেশনগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে ৩ দিন। গতকাল জেলার সাতটি উপজেলায় বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো কয়েক লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
বান্দরবান শহরের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর জেলা প্রশাসক কার্যালয়, সদর উপজেলা কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিস, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, চিফ জুডিসিয়াল কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন অফিস, পাসপোর্ট অফিস ও বিআরটিএ অফিসে হাঁটু পানিতে তলিয়ে আছে।
টানা বৃষ্টির কারণে বান্দরবান শহরের ৬০ ভাগ প্লাবিত হয়েছে। মাতামুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ২২০ সেন্টিমিটার এবং সাঙ্গু নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৮১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সেনাবাহিনীর ও প্রশাসনের জরুরি সভা হয়। সভায় বান্দরবান ৬৯ সেনা রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মো. মহিউদ্দিন, জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন, সদর জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মাহমুদুল হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেনাবাহিনীর দুটি অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প ও একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, জেলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লামা ও সদর উপজেলায়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ২৫৬টি আশ্রয় কেন্দ্রে বিশুদ্ধ পানি ও খবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও চন্দনাইশের বিতীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক ডুবে গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া দীর্ঘক্ষণ টানা বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক সমস্যা দেখা দিয়েছে। যার ফলে এলাকার লোকজন মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়েছেন।
এদিকে সাতকানিয়ার চরতি ইউনিয়নে নৌকা ডুবে নারী–শিশুসহ ৬ জন নিখোঁজ হয়। এর মধ্যে ২ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে মধ্যবয়সী এক পুরুষ ও ৩ শিশু। গতকাল বিকালে ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ চরতি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তাদের নাম পরিচয় জানা যায়নি।
তিন উপজেলার মধ্যে সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া, বাজালিয়া, ঢেমশা, সদর ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সোনাকানিয়া ইউনিয়ন, চন্দনাইশের ধোপাছড়ি ও দোহাজারী পৌরসভার আশপাশের এলাকা এবং লোহাগাড়ার আধুগনগর, চুনতি, কলাউজান, পটিবিলা, পদুয়া ও আমিরাবাদ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। চন্দনাইশের হাশিমপুর কসাইপাড়া থেকে লোহাগাড়া পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার সড়কের একাধিক জায়গায় পানিতে ডুবে রয়েছে। সড়কের ওপর প্রায় কোমর সমান থেকে বুক সমান পানি। সোমবার দিনগত রাতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারগামী বহু গাড়ি জলযটে আটকা পড়ে। এতে দূরপাল্লার যাত্রীরা দুর্ভোগ পোহান। এছাড়া তিন উপজেলায় বহু বসতঘর পানির স্রোতের ভেঙে গেছে।
লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার কবলে পড়া লোকজনকে উদ্ধার ও সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ঘর ধসে পড়েছে। বেশ কিছু মাটির ঘরও ধসে পড়ার শঙ্কা আছে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগের উপ–সহকারী প্রকৌশল আবু হানিফ জানান, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের কসাইপাড়া, সাতকানিয়ার কেরানিহাট, আশপাশ এলাকা ও লোহাগাড়া উপজেলার কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। যার ফলে মহাসড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। বিছিন্নভাবে কয়েকটি যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। বর্তমানে বিকল্প সড়ক আনোয়ারা দিয়ে বাঁশখালী হয়ে কক্সবাজারগামী যানবাহন চলাচল করছে।
পল্লী বিদ্যুৎ লোহাগাড়া জোনাল অফিসের ডিজিএম মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, দোহাজারী সাবস্টেশনে বন্যার পানি ডুকে পড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় গাছপালা পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। তার ছিঁড়ে গেছে ও বসতঘর ভেঙে বিদ্যুৎ লাইন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করা হবে।
বন্যা, টানা ৩ দিন বিদ্যুৎহীন এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যায় বিপর্যস্ত লামা উপজেলা। বন্যায় পৌর এলাকার ৮০ ভাগ ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও খাদ্য গুদামসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তর প্লাবিত হয়েছে। লামার সাথে চকরিয়ার এবং লামা–আলীকদম সড়কের বিভিন্ন পয়েন্ট বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আলীকদমের সাথে লামার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ সড়কও বন্ধ রয়েছে।
ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের কুমারী নিচের পাড়ায় মাটির দেয়াল ভেঙে চাপা পড়ে করিমা বেগম (৩৫) নামে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে শত শত ঘরবাড়ি। ভেসে গেছে অসংখ্য গবাদি পশু, হাঁস–মুরগি ও মৎস্য খামার। পানিবন্দি অবস্থায় আছে ৫০ হাজার মানুষ। উপজেলার ৫৫টি অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে শত শত নারী–পুরুষ আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার ও ঔষধ প্রদান করা হচ্ছে।