চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ দেশ ছেড়ে পালানোর পর প্রায় এক সপ্তাহ পর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিলেন উচ্চ আদালত। যদিও শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে পালাতে গিয়ে ঢাকা বিমান বন্দরে আটক হয়েছিলেন তিনি-এমন খবর প্রকাশ করেছিলো দেশের সমস্ত গণমাধ্যম। কিন্তু আটকের পর হাসান মাহমুদ কিভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন— এ নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাছান মাহমুদসহ ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ১৮ মন্ত্রী ও ৯ সংসদ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগরের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন।
এর আগে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদকে ঢাকা বিমানবন্দরে আটক করা হয়। এরপর থেকে তিনি সেনা হেফাজতে আছেন— এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া গেলেও হাছান মাহমুদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন, তিনি নিরাপদে দেশত্যাগ করেছেন সপ্তাহখানেক আগে। তবে বর্তমানে কোন দেশে তিনি অবস্থান করছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ওই সূত্র আরও জানিয়েছে, হাসান মাহমুদ দেশে নিজ দলের রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রেখেছেন। নিজ এলাকার লোকজনকে বিভিন্ন নির্দেশ-উপদেশও দিচ্ছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অচিরেই দেশে আসবেন বলেও আশ্বস্থ করছেন এমন কথা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া গিয়েছিলো।
ড. হাছান মাহমুদ যে দেশে নেই তা তিনি নিজেই সিপ্লাসটিভি ও চাটগাঁ নিউজকে নিশ্চিত করেছেন। গত শনিবার (৩১ আগস্ট) রাত ১০টা ২৭ মিনিটে হাছান মাহমুদ ফোনে কথা বলেছেন ‘সিপ্লাসটিভি ও চাটগাঁ নিউজের প্রধান সম্পাদক আলমগীর অপুর সঙ্গে। এ সময় তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন আলমগীর অপুসহ তার প্রতিষ্টান সিপ্লাসটিভির সাথে একঠানা সাড়ে তিন বছর বিভিন্ন সময়ে বিরূপ আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
তিনি অবশ্য বলেন, ‘প্রেস ক্লাব এবং সাংবাদিক ইউনিয়নের অনেক সাংবাদিক নেতা আমার বাসায় এসে তোমার ব্যাপারে ভুল বুঝিয়েছিল। এরপর আমি যা যা করেছি, তা ঠিক করিনি। এজন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি এবং ক্ষমাপ্রার্থী।’
এ সময় তিনি চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, ‘সে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমার বিরুদ্ধে নিউজ করানোর চেষ্টা করছে। তুমি পারলে বিষয়টি দেখবে।’
আটক হওয়ার পরও কিভাবে দেশ ছেড়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে অনেক কথা, এসব বলা যাবে না। তবে বিদেশে আমাদের অনেক ভাই-বন্ধু আছে, তারা সহযোগিতা করেছে। এটা দিয়ে বুঝতে হবে আমরা আবার আসবো। বিএনপি ১৭ বছর পর পারলে আমরা পারবো না?’
হাসান মাহমুদ তথ্য মন্ত্রী থাকাকালে আলমগীর অপুর বিরুদ্ধে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইকে দিয়ে সিপ্লাস ও আলমগীর অপুর নামে ভয়াবহ মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিপোর্ট করিয়েছিলেন। তাকে এফবিআই সন্ত্রাসী বানিয়েছিলেন। এসব করে তার তিনটি নিউজ পোর্টাল বিটিআরসিকে দিয়ে পালাক্রমে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে এফবিআই ক্লিয়ারেন্স দিলেও সিপ্লাসটিভি অফিস ক্ষমতার দাপট ও অপব্যবহার করে ঈদের দুদিন আগে বন্ধ করে জেলা প্রশাসনকে দিয়ে সিলগালা করে দেন। পরে অবশ্য জনপ্রিয় সিপ্লাসটিভি বন্ধ করে ব্যাপক প্রতিবাদ ও তিরস্কারের মুখোমুখি হন হাছান মাহমুদ নিজেই। তৎকালীন ডিসিকে বলে অফিস খুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সিপ্লাসটিভি আইপি টিভির জন্য আবেদন করলেও আইপি টিভির লাইসেন্স না দিয়ে একটি নিউজ পোর্টালের অনুমতি দিয়েছিলেন।
এর আগে অন্তত দশটি জাতীয় পত্রিকায় আলমগীর অপুর বিরুদ্ধে বড় বড় করে প্রথম পাতায় কুৎসা রটনা করে নিউজ করিয়েছিলেন হাছান মাহমুদ। এসব বিষয় নিয়ে তিনি এখন অনুতপ্ত হয়ে ফোন করেছিলেন বলে আলমগীর অপু এই প্রতিবেদকে জানান।
তবে ১৮ অগাষ্ট সেনা প্রধান জানিয়েছিলেন, গত পাঁচই আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দলের নেতা, বিচারক, সরকারি আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রায় ৬২৬ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল।
এর মধ্যে ৫১৫ জনই পুলিশের সদস্য, যাদের মধ্যে ২৮ জন পুলিশ কর্মকর্তা। আশ্রয়গ্রহীতাদের অধিকাংশই নিজ উদ্যোগে পরে সেনানিবাস ছেড়ে চলে গেছেন। এখন সেখানে রয়েছেন সাতজন। এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে আশ্রয়গ্রহীতাদের চারজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ইতোমধ্যেই হস্তান্তর করা হয়েছে।
যাদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়েছে, বিগত সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অকল্পনীয় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদক জানতে পেরেছে, দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা সাবেক ১৮ মন্ত্রী ও ৯ জন সংসদ সদস্য দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। সাবেক এসব মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য যাতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে জন্য তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করে দুদক।
দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া সাবেক মন্ত্রীদের মধ্যে হাসান মাহমুদ ছাড়া অন্যরা হলেন— সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী এনামুর রহমান এবং প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এবং প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, সাবেক ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী ফরিদুল হক খান, সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সাবেক ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী ফরিদুল হক খান, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল।
দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া সাবেক সংসদ সদস্যরা হলেন— সাবেক সংসদ সদস্য মো. এনামুল হক, বেনজির আহমেদ, কাজী নাবিল আহমেদ, শহিদুল ইসলাম বকুল, একেএম সরওয়ার জাহান, শেখ আফিল উদ্দিন, মেহের আফরোজ, আবু সাঈদ আল মাহমুদ ও শেখ হেলাল উদ্দিনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ২৯ আগস্ট সাবেক ৯ মন্ত্রী ও ৫ সংসদ সদস্যের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। এরা হলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা, সাবেক সংসদ সদস্য সলিম উদ্দিন তালুকদার, মামুনুর রশিদ, কাজিম উদ্দিন, নুরে আলম চৌধুরী ও জিয়াউর রহমান।
তারও আগে গত রোববার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তার স্ত্রী, কন্যা ও ছেলেসহ ১০ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।