চাটগাঁ নিউজ ডেস্ক : নিজের প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তাকে আমদানিকারক সাজিয়ে খোলা হয় ‘ক্ল্যাসিক ট্রেডিং’ নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। নামসর্বস্ব এই প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা একটি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেই ৬৫১ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এসব টাকা ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ ও ঘুষ হিসেবে অর্জিত।
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য তুলে ধরেছেন সাইফুজ্জামানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরামিট পিএলসি সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) জাহাঙ্গীর আলম। তাঁকে আমদানিকারক সাজিয়েই ‘ক্ল্যাসিক ট্রেডিং’ নামের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানটি খোলা হয়।
গ্রেফতার জাহাঙ্গীর গত বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট-২ মুহাম্মদ ইব্রাহীম খলিলের আদালতে ১৬৪ ধরায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে তিনি জাবেদ এবং তার সহযোগী আব্দুল আজিজ, উৎপল পাল ও সৈয়দ কামরুজ্জামান চক্রের বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য দেন।
এর আগে গত বুধবার নগরের কালুরঘাট থেকে জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেপ্তার করে দুদক। পরদিন দুপুরে তাঁকে হাজির করা হয় আদালতে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জুলাই হওয়া ২৫ কোটি টাকা পাচারের একটি মামলার আসামি জাহাঙ্গীর। এ মামলায় জাবেদও আসামি। তথ্য ছিল যে জাহাঙ্গীর কালুরঘাটে আরামিটের কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। এর ভিত্তিতে সেখানে গত ২৪ সেপ্টেম্বর অভিযান পরিচালনা করে তাকে আটক ও জাবেদের সাক্ষরিত চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করা ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকার মধ্যে ৮৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।
দুদকের আইনজীবী মোকাররম হোসাইন বলেন, ‘জবানবন্দিতে সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামানের বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচারের বিষয়ে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীরের অনুকূলে থাকা ক্ল্যাসিক ট্রেডিং নামের একটি হিসাব ব্যবহার করে সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান ৬৫১ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। ব্যাংক থেকে এসব টাকা তোলার পর হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন জাহাঙ্গীর। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত সময়ে এসব টাকা পাচার করা হয়।’নিজের প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তাকে আমদানিকারক সাজিয়ে খোলা হয় ‘ক্ল্যাসিক ট্রেডিং’ নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। নামসর্বস্ব এই প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা একটি ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেই ৬৫১ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এসব টাকা ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ ও ঘুষ হিসেবে অর্জিত।
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য তুলে ধরেছেন সাইফুজ্জামানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরামিট পিএলসি এক সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম)। তাঁর নাম জাহাঙ্গীর আলম। তাঁকে আমদানিকারক সাজিয়েই ‘ক্ল্যাসিক ট্রেডিং’ নামের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানটি খোলা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইব্রাহীম খলিলের আদালতে জাহাঙ্গীর আলম জবানবন্দি দিয়েছেন।
দুদকের আইনজীবী মোকাররম হোসাইন জানান, জবানবন্দিতে আসামি জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ২০১৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তাঁকে আমদানিকারক সাজিয়ে ক্ল্যাসিক ট্রেডিংয়ের নামে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এরপর সাইফুজ্জামানের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউসিবিএল ব্যাংকের স্টেশন রোড শাখায় ক্ল্যাসিক ট্রেডিংয়ের নামে হিসাব খোলা হয়। হিসাবে নমিনি হিসেবে রাখা হয় জাহাঙ্গীরের স্ত্রীকে। ওই হিসাবের নামে ব্যাংক থেকে পাঁচ থেকে ছয়টি চেক বই (প্রতিটিতে ৫০ পাতা) নেন সাইফুজ্জামানের সহযোগী আবদুল আজিজ (বর্তমানে গ্রেপ্তার)। কমপক্ষে ৩০০টি খালি চেকে জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সই নেওয়া হয়।
ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের জুবিলি রোড শাখা ও ইউসিবিএল ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে সাইফুজ্জামানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আরামিট সিমেন্ট, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম ও আরামিট স্টিল পাইপস লিমিটেডের নামে শত কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। শুধু ইসলামী ব্যাংকের জুবিলি রোড শাখা থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে পাঁচ শ কোটি টাকা। জাহাঙ্গীর জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, এসব ঋণের টাকা প্রথমে ক্ল্যাসিক ট্রেডিংয়ের নামের হিসাবটিতে স্থানান্তর করা হয়। পরে তাঁর সই করা খালি চেক ব্যবহার করে ধাপে ধাপে টাকা সাইফুজ্জামানের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হতো। এরপর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ইয়াসিনুর রহমান, মো. হোসাইনসহ কয়েকজন টাকাগুলো ব্যাংক হিসাব থেকে তুলে নিতেন। পরে হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা সাইফুজ্জামানের নির্দেশনা অনুযায়ী বিদেশে পাচার করা হতো। সাইফুজ্জামানের হয়ে এসব কাজের দেখভাল করতেন প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা মো. আবদুল আজিজ ও উৎপল পাল। তাঁরা গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
ঘুষের টাকাও অভিনব কৌশলে সাইফুজ্জামান পাচার করতেন বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানিয়েছেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ইউসিবিএলের চেয়ারম্যান ছিলেন। মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করে স্ত্রী রুকমিলা জামানকে চেয়ারম্যান করেন। তবে রুকমিলা নামমাত্র চেয়ারম্যান হলেও দায়িত্ব ছিল মন্ত্রী সাইফুজ্জামানের কাছে। এই ব্যাংক থেকে শিল্পপতিদের ঋণ দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষ নেওয়া হতো। এসব ঘুষের টাকা নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের নামে খোলা ভুয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে রেখে বিদেশে পাচার করা হতো। চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের একটি জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠান এবং কালুর ঘাটের একটি তৈরি পোশাক কারখানা থেকে ঋণ দেওয়া বাবদ ৭৫ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার পর বিদেশে পাচারের তথ্য জবানবন্দিতে দেন জাহাঙ্গীর।
১৭ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুজ্জামানের প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা মো. আবদুল আজিজ ও উৎপল পালও দুদকের কাছে অর্থ পাচারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ২২ সেপ্টেম্বর তাঁরা আদালতে জবানবন্দি দেন। সেখানে সাইফুজ্জামানের নির্দেশে যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে ২৫ কোটি টাকা পাচার করার তথ্য জানানো হয়। ইউসিবিএল ব্যাংক থেকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর হওয়ার পর সেই টাকা চারটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে একই ব্যাংকে খোলা হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে এসব টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। জালিয়াতি ও আত্মসাতের এ ঘটনা ঘটে ২০১৯-২০ সালে। তখন সাইফুজ্জামান ভূমিমন্ত্রী ছিলেন।দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাইফুজ্জামান ও তাঁর সহযোগী আবদুল আজিজ, উৎপল পাল ও সৈয়দ কামরুজ্জামান মাধ্যমে বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের তিনজনেরই আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর আদালত সাইফুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রীকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। এরপরও তাঁরা বিদেশে পালিয়ে যান। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, জাবেদের ৯টি দেশে বিপুল সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, দুবাইতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে ১০টি বাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায়ও সম্পদ রয়েছে।
দুদকের কর্মকর্তাদের মতে, দেশের ভেতর থেকে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন সাইফুজ্জামান ও তাঁর পরিবার। এভাবে বহু দেশে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তাঁরা।
চাটগাঁ নিউজ/এসএ